ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির পর আলোচনায় সিন্ধু পানিচুক্তি

পাকিস্তানের জামশোরো শহরে সিন্ধু নদের বুকে জেগেছে চর। গত ১৫ মার্চের চিত্রছবি: রয়টার্স

যুদ্ধবিরতি নিয়ে ভারত–পাকিস্তানের সমঝোতার পর দুই দেশেই জনমনে স্বস্তি ফিরছে। সংঘাতপূর্ণ এলাকাগুলোয় ফিরতে শুরু করেছেন মানুষ, খুলছে দোকানপাট। তবে পাল্টাপাল্টি হামলা থামলেও সিন্ধু পানিচুক্তি এখনো স্থগিত রেখেছে ভারত। বিষয়টি নিয়ে একটি সুরাহায় পৌঁছাতে চায় পাকিস্তান। চুক্তিটি নিয়ে এরই মধ্যে আলোচনায় বসার ইঙ্গিত দিয়েছেন দেশটির নেতারা।

গত ২২ এপ্রিল ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হন। তার পরপরই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হামলায় মদদ দেওয়ার অভিযোগ তুলে সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত করে নয়াদিল্লি। তখন দুই দেশ পাল্টাপাল্টি নানা পদক্ষেপ নিলেও পানিচুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। কারণ, ১৯৬০ সালে চুক্তি হওয়ার পর এই প্রথম কোনো পক্ষ সেটি স্থগিত করল।

গতকাল শনিবার ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি শুরু হলেও পানিচুক্তি যে স্থগিত থাকছে—সূত্রের বরাতে এমন খবর সামনে আনে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। পরে আজ রোববার পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ জিও নিউজকে বলেন, সিন্ধু পানিচুক্তি, কাশ্মীর সংকট ও নিরাপত্তা নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন তাঁরা। তবে ওই আলোচনার দিনক্ষণ স্পষ্ট করেননি তিনি।

সিন্ধু পানিচুক্তি নিয়ে ভারতকে চাপ দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারস্থ হওয়ার কথাও বলছেন পাকিস্তানের বিশেষজ্ঞরা। যুদ্ধবিরতিতে মার্কিন প্রশাসনের বড় ভূমিকার পর পাকিস্তানের পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক সদস্য জাওয়াইদ লতিফ সংবাদমাধ্যম ডনকে বলেন, চুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত থেকে ভারতের সরে দাঁড়ানো নিশ্চিত করতে সরকারের উচিত দ্রুত যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিষয়টি তোলা।

আজ ভোরে শ্রীনগরের একটি বেকারির সামনে ভিড় করেছিলেন অনেকে। সেখানে রুটি কেনার জন্য সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা শাকিলা জান বলেন, ‘যুদ্ধবিরতির খবরে আমি খুব খুশি।’

পাকিস্তানের কৃষিকাজ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর জন্য সিন্ধু নদের পানি গুরুত্বপূর্ণ। দেশটির প্রায় ৮০ শতাংশ কৃষিজমিতে এই নদের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হয়। ৫ মে ডনের খবর অনুযায়ী, চুক্তির আওতায় থাকা চেনাব নদীর পানি ভারত বন্ধ করায় নদীটির পাকিস্তান অংশে পানি সরবরাহ কমে আসে। যদিও পরদিনই আবার পানি খুলে দেয় ভারত সরকার। পরে আজ পাকিস্তানের পাঞ্জাব সরকারের এক কর্মকর্তার বরাতে সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, চেনাব, ঝিলাম, সিন্ধুসহ সব নদীর পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক আছে।

আরও পড়ুন
যুদ্ধবিরতির পর জম্মু অঞ্চলের পুঞ্চ জেলায় নিজ বাড়িতে ফিরছে একটি পরিবার। আজ ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে
ছবি: এএফপি

ফিরছে স্বস্তি, খুলছে দোকানপাট

পেহেলগামে হামলা নিয়ে চলমান উত্তেজনার মধ্যে ৬ মে দিবাগত রাতে হঠাৎ পাকিস্তান ও দেশটির নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে অভিযান চালায় ভারত। তার পর থেকে পাল্টাপাল্টি তীব্র হামলা শুরু করে দুই দেশ। পরে ১০ মে ভোরে ভারতে ‘বুনইয়ান-উন-মারসুস’ নামে অভিযান চালায় পাকিস্তান। টানা চার দিনের এই পাল্টাপাল্টি হামলায় দুই দেশে অন্তত ৫৫ জন নিহত হয়েছেন।

প্রায় তিন দশকের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সবচেয়ে বড় এ সংঘাতে ক্ষতির মুখে পড়েন দুই দেশের সাধারণ মানুষ। যুদ্ধবিরতি শুরুর পর তাঁদের মধ্যে স্বস্তি ফিরতে শুরু করেছে। অনেকেই কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখার কাছে ঘরবাড়িতে ফিরছেন। শ্রীনগরে খুলতে শুরু করেছে দোকানপাট। তবে যেকোনো পরিস্থিতির জন্য তাঁরা সতর্ক রয়েছেন বলে জানান স্থানীয় দোকানি মোহাম্মদ আনাস।

আজ ভোরে শ্রীনগরের একটি বেকারির সামনে ভিড় করেছিলেন অনেকে। সেখানে রুটি কেনার জন্য সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা শাকিলা জান বলেন, ‘যুদ্ধবিরতির খবরে আমি খুব খুশি। কিন্তু গত রাতেও বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গেছে। এটা আমাকে আবারও উদ্বিগ্ন করেছে। আমরা আর কোনো দেশকেই বিশ্বাস করি না। তারা যেকোনো মুহূর্তে মন পরিবর্তন করতে পারে।’

যুদ্ধবিরতির পর খুলেছে বাজার। নিজের গাড়িতে খাবারসহ নানা ধরনের নিত্যপণ্য বোঝাই করছেন এক ব্যক্তি। আজ পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের চাকোথি গ্রামে
ছবি: এএফপি

যুদ্ধবিরতির পর আজ উড়োজাহাজ চলাচলের জন্য পাকিস্তানের আকাশসীমা খুলে দেওয়া হয় বলে জানিয়েছে দেশটির বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। আর হামলা বন্ধের পর পাকিস্তানের মানুষ কী ভাবছেন, তা জানতে করাচির বাসিন্দা আহমেদ ইয়ারের সঙ্গে কথা হয় আল–জাজিরার। তিনি বলেন, ‘আমাদের সাধারণ জীবনযাপনে ফিরতে হবে এবং যেসব বিষয় দেশকে ভোগাচ্ছে, তা নিয়ে কাজ করতে হবে।’

আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও যুদ্ধবিরতিকে স্বাগত জানানো হচ্ছে। যুদ্ধবিরতির পরপরই ভারত ও পাকিস্তানকে অভিনন্দন জানায় জাতিসংঘ, যুক্তরাজ্য, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশ। আর আজ ভ্যাটিকানের সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে উপস্থিত মানুষের উদ্দেশে ভাষণে ভারত ও পাকিস্তানকে স্বাগত জানিয়ে ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের ধর্মগুরু পোপ লিও চতুর্দশ বলেন, সৃষ্টিকর্তা যেন বিশ্বের শান্তি বজায় রাখেন।

কাশ্মীর সংকট নিয়ে একটি সমাধানে পৌঁছাতে ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন ট্রাম্প।

তুরস্ক ও সৌদি আরবের পক্ষ থেকেও নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদকে স্বাগত জানানো হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান কূটনীতিক কাজা কালাস আজ বলেছেন, যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর তিনি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। সংঘাত বন্ধের পথে যাত্রায় এই যুদ্ধবিরতি বড় একটি পদক্ষেপ বলে মনে করেন তিনি।

আরও পড়ুন
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
ফাইল ছবি: রয়টার্স

কাশ্মীর নিয়ে কাজ করতে চান ট্রাম্প

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতির খবর প্রথম সামনে এনেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এতে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যস্থতা করেছে বলেও জানান। ট্রাম্পের এ প্রচেষ্টার প্রশংসা করে আজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বলেন, অভিন্ন স্বার্থ রক্ষায় দশকের পর দশক ধরে ঘনিষ্ঠভাবে একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান।

পরে আজ কাশ্মীর সংকট নিয়ে একটি সমাধানে পৌঁছাতে ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন ট্রাম্প। নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে তিনি লেখেন, ‘আমি আপনাদের (ভারত ও পাকিস্তান) সঙ্গে কাজ করব, এটা দেখার জন্য যে “হাজার বছর” পরেও কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে কোনো সমাধানে পৌঁছানো যায় কি না।’

তবে ট্রাম্পের এ প্রস্তাব ভারত ভালোভাবে নেবে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকদের অনেকে। কারণ, অনেক আগে থেকেই কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ চায় না নয়াদিল্লি। নয়াদিল্লিভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর পিস স্টাডিজের গবেষক মোহাম্মদ ওয়াসিম মাল্লা আল–জাজিরাকে বলেন, ট্রাম্পের প্রস্তাব ভারতের উদ্বেগ বৃদ্ধি করতে পারে।

মোহাম্মদ ওয়াসিম মাল্লা বলেন, দশকের পর দশক ধরে কাশ্মীর সংকটকে ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় বিষয় হিসেবেই দেখে আসছে নয়াদিল্লি। এমন পরিস্থিতিতে তৃতীয় কোনো পক্ষের জড়িত হওয়ার ইঙ্গিত ভারত, বিশেষ করে দেশটির বর্তমান সরকার বিপদ হিসেবেই দেখবে। ভারতের যে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং দেশটির যেসব কৌশলগত অগ্রাধিকার রয়েছে, তাতে ট্রাম্পের প্রস্তাব বিবেচনায় নেওয়া ভারতের জন্য কঠিন হবে।

আরও পড়ুন