বেইজিংয়ে দুর্লভ পাখিদের বাঁচাতে একাই লড়ছেন সিলভা

চীনে বিভিন্ন প্রজাতির দুর্লভ পাখি শিকার ও বিক্রি একটি লাভজনক পেশাছবি: বিবিসির স্ক্রিনশট

রাতের অন্ধকার তখনো কাটেনি। বেইজিংয়ের উপকণ্ঠে মাইলের পর মাইল বিস্তৃত তৃণভূমিজুড়ে ‘সিলভা গু’র চোখ প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে বেড়াচ্ছে। মাঠের মধ্যে লুকিয়ে থাকার জন্য আমরা যখন একটি জায়গা খুঁজছিলাম, তখন তিনি ফিসফিসিয়ে কথা বলছিলেন।

আমাদের পেছনে বেইজিং মহানগর তখনো ঘুমে আচ্ছন্ন। আমরা অপেক্ষার প্রহর গুনছি। তৃণভূমির চারপাশে গাঢ় নিস্তব্ধতায় নিজেদের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছুই আমাদের কানে আসছিল না।

সূর্যোদয়ের আগে আকাশে যখন একটু একটু করে আলো ফুটতে শুরু করেছে, তখন হঠাৎ পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। শিকারিরা এসে পড়েছে। ছিপছিপে গড়নের চটপটে সিলভা প্রথমে এগিয়ে গেলেন। আমরা ক্যামেরা হাতে তাঁকে অনুসরণ করলাম।

ধীরপায়ে ঘন গাছপালার ভেতর দিয়ে এগিয়ে গিয়ে আমরা একটি ছোট খোলা জায়গায় পৌঁছালাম। আর তখনই আমাদের চোখে পড়ল পাখি ধরার একটি ফাঁদ। এটি এতটাই সূক্ষ্ম যে একেবারে কাছে আসা ছাড়া টের পাওয়া যায় না।

চীনে প্রতিবছর পোষা প্রাণীর বাজার অথবা মাংসের জন্য এভাবে জাল পেতে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি ধরা হয়। চীনের বর্তমান ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতিতে দুর্লভ পাখি ধরে কালোবাজারে বিক্রি করা এখন একটি ‘অল্প পুঁজি ও উচ্চ মুনাফার’ পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি সাইবেরিয়ান রুবিথ্রোট পাখি প্রায় ২ হাজার ইউয়ানে (২৮০ ডলার) বিক্রি হয়, যা অনেক কৃষকের মাসিক আয়ের চেয়েও বেশি।

সিলভা গু বলেন, ‘মানুষের এই পৃথিবীতে আমি ওদের (পাখি) রক্ষা করতে চাই।’ পাখিদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা এক নেশার মতো। তিনি স্বপ্নেও দেখেন, তিনি ডানা মেলে উড়ছেন।

শিকারির জালে বন্দী

প্রতিবছর শীতের আগে সাইবেরিয়া বা মঙ্গোলিয়া থেকে লাখ লাখ পাখি দক্ষিণে উষ্ণতর দেশের দিকে পাড়ি জমায়। আর এই পরিযায়ী পাখিদের ৯টি প্রধান যাত্রাপথের চারটিই চীনের ওপর দিয়ে গেছে। প্রায় দেড় হাজার প্রজাতির পাখির বাস এখানে, যার মধ্যে ৮০০ প্রজাতিই পরিযায়ী। দীর্ঘ ও বিপজ্জনক পথ পাড়ি দিয়ে বেইজিংয়ের তৃণভূমিতে বিশ্রাম নিতে থামে তারা। আর সেখানেই পাতা থাকে শিকারিদের মরণফাঁদ।

আমরা যে জালের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলাম, সেটি বাঁশের খুঁটির সাহায্যে পুরো মাঠের অর্ধেকটা জুড়ে বিছানো ছিল। জালের মাঝখানে আটকে পড়েছিল ‘মিডো পিপিট’ নামের একটি পরিযায়ী পাখি। যতই মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছিল, ততই জালের সুতায় জড়িয়ে যাচ্ছিল পাখিটি।

শিকারি ব্যক্তি আমাদের দেখে পালানোর চেষ্টা করলেন। তাঁর কোমরে থাকা একটি ছোট ব্যাগ থেকে আধা ডজন ছোট পাখিকে আকাশে উড়িয়ে দিয়ে ঝোপঝাড়ের দিকে ছুটে গেলেন তিনি। তবে সিলভা তাঁকে কৌশলে ধরে ফেললেন এবং পুলিশ আসার আগপর্যন্ত আটকে রাখলেন। ৪০ মিনিট পর পুলিশ এসে ওই শিকারিকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়।

একাই লড়ছেন সিলভা

ত্রিশোর্ধ্ব সিলভা গু ১০ বছর ধরে নিজের জমানো টাকায় পাখিশিকারিদের পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার কাজ করছেন। গড়ে তুলেছেন ‘বেইজিং মাইগ্রেটরি বার্ড স্কোয়াড’ নামের একটি দল। একসময় পুলিশ এসব অপরাধকে গুরুত্ব না দিলেও সিলভার নিরন্তর চেষ্টায় পরিস্থিতি বদলেছে। তবে এই কাজটি সহজ ছিল না। একবার বড় এক পাখি বিক্রেতার হাতে মারও খেয়েছেন তিনি।

পাখিদের প্রতি সিলভার ভালোবাসা শৈশব থেকেই। তিনি ১৯৯০-এর দশকে একটি ভিন্ন বেইজিংয়ে বড় হয়েছেন—যা ছিল বিশাল ও রাজকীয়, কিন্তু আজকের মতো অর্থনৈতিক পরাশক্তি নয়।

সিলভার মনে পড়ে শহরের শেষ প্রান্তে তৃণভূমিতে ঘুরে বেড়ানোর কথা। সেখানে তিনি নানা প্রজাতির পাখি, ব্যাঙ ও সাপ দেখতে পেতেন। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে সবকিছু পাল্টে গেছে। চীনের বিকাশমান অর্থনীতিতে লাখো গ্রামীণ মানুষ কাজের খোঁজে শহরে পাড়ি জমিয়েছেন। এই দ্রুত নগরায়ণের ফলে তৃণভূমিগুলোয় গড়ে উঠেছে একের পর এক সুউচ্চ ভবন। ধ্বংস হয়ে গেছে পাখি ও অন্যান্য প্রাণীর আবাস। এই পরিবর্তন সিলভাকে ব্যথিত করেছে। সে কারণেই তিনি বন্য প্রাণী সংরক্ষণে কাজ করার পথ বেছে নিয়েছেন।

কাজের কঠিন ধরন আর জীবনের ঝুঁকির কারণে এখন আর কোনো স্বেচ্ছাসেবক তাঁর সঙ্গে নেই। সিলভা এখন একা। আধুনিক স্যাটেলাইট প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে তিনি খুঁজে বের করেন শিকারিদের যাতায়াতের পথ। তিনি বলেন, ‘পাখি পোষা চীনের একটি পুরোনো ঐতিহ্য, যা মূলত কিউং রাজবংশের আমল থেকে চলে আসছে। বয়স্ক মানুষেরা এটিকে আভিজাত্যের প্রতীক মনে করেন। কিন্তু তাঁরা বোঝেন না, এই শখের জন্য কতশত পাখি মারা পড়ছে।’

পাখিদের রক্ষায় কাজ করছেন সিলভা গু
ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

বন্য পাখি রক্ষায় অভিযান

বেইজিংয়ের লিয়াংশুই নদীর ধার ঘেঁষে কয়েক মাইল লম্বা এক দেয়াল। সেখানে ছোট ছোট খাঁচায় বন্দী কিছু পাখির দেখা মিলল। কাছেই সবজি বাজারের সামনে কালো কাপড়ে ঢাকা খাঁচা হাতে দাঁড়িয়ে এক ব্যক্তি। পথচারীদের ফিসফিস করে বলছেন, তাঁর কাছে থাকা পাখিটি অত্যন্ত দুর্লভ, দাম হাঁকছেন ১ হাজার ৯০০ ইউয়ান (প্রায় ২৭০ ডলার)।

পুরোনো বেইজিংয়ের এই চিরচেনা জায়গায় গড়ে উঠেছে এক বিশাল অবৈধ বাজার। নদীর ধারের ফুটপাতে রোদঝলমলে এক সকালে দেখা গেল পুরোনো গয়না থেকে শুরু করে নকল দাঁত—সবই মিলছে অস্থায়ী দোকানে। একটু ভেতরে একটি ছোট পার্কে ঢুকতেই দেখা গেল অন্য দৃশ্য। একদিকে স্পিকারে গান বাজিয়ে বয়স্ক নারীদের নাচের মহড়া চলছে, অন্যদিকে পঞ্চাশোর্ধ্ব কয়েকজন ব্যক্তি হাতে পাখির খাঁচা নিয়ে জটলা পাকিয়েছেন।

তবে এদিন আর পাখি বিক্রি হলো না। হঠাৎ পুলিশের উপস্থিতি দেখে সবাই সতর্ক হয়ে গেলেন। পুলিশ পাখি ব্যবসায়ীদের নাম-ঠিকানা নথিভুক্ত করতে শুরু করলে একজন প্রতিবাদী কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘আমি তো কেবল পাখি নিয়ে একটু হাঁটতে বেরিয়েছি। বেইজিংয়ের পার্কে খাঁচাবন্দী পোষা পাখি নিয়ে মালিকদের আড্ডা দেওয়ার দৃশ্য বেশ পুরোনো হলেও এখন পরিস্থিতি বদলেছে।’

চীনের জননিরাপত্তা মন্ত্রণালয় এ বছর বন্য প্রাণী রক্ষায় বিশেষ অভিযান ঘোষণা করেছে। ইন্টারপোলের তথ্যমতে, বিশ্বে অবৈধ বন্য প্রাণী বাণিজ্যের বাজার প্রায় ২ হাজার কোটি ডলারের। বন্য প্রাণী সংরক্ষণ সংস্থাগুলোর মতে, চীন এই বাণিজ্যের বৃহত্তম ভোক্তা। তবে আন্তর্জাতিক চাপে চীন এখন বন্য প্রাণী বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা ও কঠোর নজরদারির পথে হাঁটছে। চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম এখন বন্য পাখি রক্ষা করাকে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য বলে প্রচার করছে। সরকারের এ অবস্থানের কারণেই সিলভার মতো স্বেচ্ছাসেবীরা পুলিশের সহযোগিতা পাচ্ছেন।

বেইজিংয়ের উপকণ্ঠে সেদিন সিলভা যে শিকারিকে আটকেছিলেন, তাঁর বয়স পঞ্চাশের কোঠায়। নিজেকে নির্মাণশ্রমিক দাবি করে তিনি বারবার ক্ষমা চাইছিলেন। এমনকি সিলভার পায়ে ধরতেও রাজি ছিলেন। কিন্তু সিলভা তাঁর ফোন তল্লাশি করতেই বেরিয়ে আসে আসল রহস্য। ফোনে কয়েক ডজন খাঁচাবন্দী পাখির ছবি ও ভিডিও পাওয়া যায়। পরে পুলিশসহ তাঁর বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে বিক্রির অপেক্ষায় থাকা সব পাখি উদ্ধার করা হয়।

এ বছর ডালিয়ান শহরে এক বিশাল অভিযানে পুলিশ ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করে এবং ১২ হাজারের বেশি ‘ইয়েলো-ব্রেস্টেড বান্টিং’ উদ্ধার করে, যা চীনে সর্বোচ্চ সংরক্ষিত পাখি।

সিলভা আক্ষেপ করে বলেন, বড় বড় শিকারি ধরা পড়লেও শাস্তির মাত্রা এখনো অনেক কম। তবে তিনি আশাবাদী। গত ১০ বছরে তিনি নিজের হাতে ২০ হাজারেরও বেশি পাখি উদ্ধার করেছেন এবং অসংখ্য শিকারির জাল ধ্বংস করেছেন।

সিলভা মনে করেন, নতুন প্রজন্ম যখন জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব বুঝবে, তখনই প্রকৃত পরিবর্তন আসবে। তিনি বলেন, ‘এটি আমার আদর্শ। আর আদর্শ থাকলে সেখানে অবিচল থাকতে হয়। আমি থাকব।’