বাইডেনের পর সির ভিয়েতনাম সফর কেন গুরুত্বপূর্ণ

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও ভিয়েতনামের নেতা নগুয়েন ফু ত্রংফাইল ছবি: রয়টার্স

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং আজ মঙ্গলবার দুই দিনের সফরে ভিয়েতনাম যাচ্ছেন। রাষ্ট্রীয় এ সফরে তিনি ভিয়েতনামের নেতা নগুয়েন ফু ত্রংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। আশা করা হচ্ছে, সাক্ষাৎকালে চীনের নেতা কমিউনিস্টশাসিত এ দুই প্রতিবেশীর মধ্যকার ঐতিহাসিক বন্ধুত্বকে উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে হ্যানয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবেন।

এক বছর আগে বেইজিং সফর করেছিলেন ফু ত্রং। তখন তাঁকে বিদেশি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য বরাদ্দ চীনের সর্বোচ্চ পদক দেওয়া হয়। সি চিন পিং তখন দুই দেশের সম্পর্ককে ‘সহযোদ্ধা (কমরেড) ও ভ্রাতৃত্বের’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। চীনের প্রেসিডেন্টের ভাষায়, দুই দেশ ‘পাহাড় ও নদীর মাধ্যমে সংযুক্ত; ঠোঁট ও দাঁতের মতো কাছাকাছি তাদের অবস্থান।’

ধারণা করা হচ্ছে, সি চিন পিংয়ের ‘কমিউনিটি অব কমন ডেসটিনি’-এ যোগ দেওয়ার ঘোষণা দেবে ভিয়েতনাম। এই কমিউনিটি একটি চীনকেন্দ্রিক ধারণা, যা মূলত প্রতীকী। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক ব্যবস্থার জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হয় এটিকে।

গত সেপ্টেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন হ্যানয় সফর করেন। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিস্তৃত কৌশলগত অংশীদার’ হিসেবে উন্নীত হয় ভিয়েতনাম। এর মাধ্যমে এক ধাপ এগিয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নিরিখে ভিয়েতনামকে যে স্তরে রাখে চীন, সেই একই স্তরে জায়গা করে নেয় ওয়াশিংটন। পুরো বিষয়টি যে চীনকে ধাক্কা দিয়ে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য।

এ সপ্তাহের হ্যানয় সফরে ভিয়েতনামকে তার পরিবহন অবকাঠামো উন্নত করতে সহায়তার জন্য উন্নত রেলপ্রযুক্তি দেওয়ারও প্রস্তাব দেবে চীন। এর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ চীন থেকে ভিয়েতনামের হাইফং বন্দর পর্যন্ত রেল–সংযোগ। চীন বিশ্বের বৃহত্তম খনিজ রপ্তানিকারক ও পরিশোধনকারী দেশ। খনিজ বৈদ্যুতিক যানবাহন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য অপরিহার্য।

গত সেপ্টেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন হ্যানয় সফর করেন। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিস্তৃত কৌশলগত অংশীদার’ হিসেবে উন্নীত হয় ভিয়েতনাম। এর মাধ্যমে এক ধাপ এগিয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নিরিখে ভিয়েতনামকে যে স্তরে রাখে চীন, সেই একই স্তরে জায়গা করে নেয় ওয়াশিংটন। পুরো বিষয়টি যে চীনকে ধাক্কা দিয়ে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য।

এ সফরকালে দেশ দুটি কিছু বিষয়ে অবশ্যই কথা বলবে না, অন্তত জনসমক্ষে। যেমন দক্ষিণ চীন সাগরের দ্বীপ নিয়ে তাদের মধ্যে তিক্ত আঞ্চলিক বিরোধ অথবা গত শতকের ৭০ ও ৮০-এর দশকে তাদের মধ্যকার উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক। ১৯৭৯ সালে দেশ দুটি যুদ্ধে জড়িয়েছিল, যাতে প্রাণ যায় উভয় পক্ষের হাজারো সেনার। চীনের দীর্ঘ ঐতিহাসিক উপনিবেশেরও কোনো উল্লেখ থাকবে না, যা ‘হাজার বছরের দখল’ হিসেবে পরিচিত। মেকং নদীতে চীনের বাঁধ দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ভিয়েতনাম যে দুর্দশায় পড়েছে, তা–ও অনুচ্চারিতই থাকবে।

তবে এসব বিরোধপূর্ণ বিষয় নিয়ে ভিয়েতনামিদের মধ্যে অনলাইনে নানা আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। চীনের তুলনায় দেশটিতে ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর ততটা কড়াকড়ি আরোপ করা হয়নি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভিয়েতনামের এক নাগরিক লিখেছেন, ‘আমরা শুধু শান্তি চাই, তাই প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং দয়া করে (আমাদের দেশে) আসবেন না।’ দক্ষিণ চীন সাগরের প্রায় পুরোটাই নিজেদের বলে দাবি করে থাকে চীন—বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করে আরেকজন লিখেছেন, ‘যদি সি চিন পিং নাইন-ড্যাশ লাইন (সমুদ্রসীমায় চীনের দাবি করা বিতর্কিত অংশ) সরিয়ে দেন, তাহলে দুই দেশ অবিলম্বে ভ্রাতৃত্বের বাঁধনে বাঁধা পড়তে পারে।’

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য যেকোনো স্থানের চেয়ে ভিয়েতনামের সাধারণ মানুষের মধ্যে চীনবিরোধী মনোভাব তীব্র হতে পারে। ফরাসি ও মার্কিনদের পরাস্ত করে স্বাধীনতা পাওয়া একটি জাতির মধ্যে জাতীয়তাবাদ নিয়ে গর্ব থাকা স্বাভাবিক। দেশটি তার উত্তরের বৃহৎ প্রতিবেশীর ঐতিহাসিক ভয়কেও জয় করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছে। ভিয়েতনামিদের মনে থাকা এই অনুভূতির ব্যাপারে দেশটির কমিউনিস্ট নেতাদের সব সময় সতর্ক থাকার জরুরত আছে বৈকি।

গত সেপ্টেম্বরে ভিয়েতনাম সফর করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন
ছবি: এএফপি

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় মাঝেমধ্যেই ভিয়েতনামে চীনবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে। এমনকি ২০১৪ সালে দাঙ্গা বাধে দেশটিতে, যাতে বহু মানুষের প্রাণ যায়। সে সময় কয়েক ডজন বিদেশি মালিকানাধীন কারখানা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওই দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটেছিল ভিয়েতনাম যে জলসীমাকে তাদের নিজস্ব বলে দাবি করে থাকে, সেখানে চীনের তেল পরিশোধনের স্থাপনা (ওয়েল রিগ) বসানো নিয়ে। কয়েক বছর আগে হ্যানয়ের দোকানগুলোয় কেবল ভিয়েতনামের তৈরি পণ্য বিক্রি শুরু হয়েছিল। চীন থেকে আমদানি করা পণ্য তারা বর্জন করে তখন।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে উভয় দেশের সরকারই ২০১৪ সালের তেল পরিশোধন স্থাপনা বসানোর মতো বিষয়গুলো এড়িয়ে গেছে। এসব বিষয়ে জনগণের অনুভূতিকে তারা ‘ঢাকা’ দেওয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু তারা কখনোই সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নেয়নি।

সি চিন পিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অধীন চীনা বিনিয়োগ গ্রহণ করতেও অনিচ্ছুক ছিল ভিয়েতনাম। কেননা, এসব বিনিয়োগের মাধ্যমে ভিয়েতনামে চীনের উপস্থিতি ভিয়েতনামিদের মধ্যে বিরক্তির সৃষ্টি করতে পারে, এমন ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে।

ভিয়েতনামের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার চীন। দুই দেশের মধ্যে বছরে ২০০ বিলিয়ন বা ২ হাজার কোটির ডলারের বাণিজ্য হয়। চীন ভিয়েতনামে সবচেয়ে বড় সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগকারীও বটে। এখানেও পিছিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র।

মার্কিন কোম্পানিগুলোর জন্য বিকল্প উত্পাদনকেন্দ্র হিসেবে ভিয়েতনামকে বিবেচনা করার সব আলোচনা সত্ত্বেও তারা চীনের ওপর তাদের নির্ভরতা কমাতে চায়।

এসব কিছুর ওপর এখনো দুই দেশের নেতৃত্বের মধ্যে একটি আদর্শিক বন্ধন রয়েছে। সি চিন পিং ও ফু ত্রং—উভয়ই তাঁদের দলের কর্তৃত্ববাদী মতাদর্শের ব্যাপারে কট্টরপন্থী, পশ্চিমা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি তাঁদের অসন্তুষ্টি রয়েছে এবং রাজনৈতিক জীবনে নিজ নিজ দলে তাঁরা কঠোর নিয়ন্ত্রণ রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

তবু তাঁদের কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সব সময়ই প্রবল মতপার্থক্য আছে বৈকি।

চীন উদীয়মান একটি পরাশক্তি। তারা মার্কিন নেতৃত্বাধীন শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী একমুখী বিশ্বব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে এবং আঞ্চলিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ভিয়েতনামের শক্তিমত্তা মাঝারি মানের। তারা চায় যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে নিজেদের সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রেখে যতটা সম্ভব সুবিধা ও নিরাপত্তা নিতে। রাশিয়ার সঙ্গে ভিয়েতনামের ঐতিহাসিকভাবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, যার মূল্য এখনো আছে।

১৯৮৬ সালে সোভিয়েত–বিচ্ছিন্নতার পর ভিয়েতনাম একটি নমনীয় বিদেশনীতি আঁকড়ে ধরে। এর ভিত্তি চারটি বিষয়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত—কোনো সামরিক জোটে অন্তর্ভুক্তি নয়, কোনো একটি দেশের বিরুদ্ধে অন্য দেশের পাশে দাঁড়ানো নয়, ভিয়েতনামের ভূখণ্ডে কোনো বিদেশি সামরিক ঘাঁটি নয় এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগ নয়। এই নমনীয় বিদেশনীতিকে ফু ত্রং ‘বাঁশের কূটনীতি’ বলে অভিহিত করে থাকেন।

এই নীতির সারকথাটি হলো সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়। তবে এরপরও চীন কোনো বিভ্রমের মধ্যে থাকবে না, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভিয়েতনামের সম্পর্কের উন্নতি এ অঞ্চলে চীনা প্রভাবের বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধকতা ছাড়া কিছু নয়।

আরও পড়ুন