চীন-ভুটান চুক্তিতে কেন উদ্বিগ্ন ভারত

ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুকের সঙ্গে রানী জেতসুন ফেমাফাইল ছবি: রয়টার্স

৯ জানুয়ারি দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভুটানে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচন ঘিরে ভুটানের ওপর ঘনিষ্ঠ নজর রাখছে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীন। হিমালয়ের অঞ্চলের দেশটি নিয়ে চীন-ভারতের এই দৌড়ঝাঁপ চোখে পড়ার মতো বটে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, সীমান্তে নিজেদের কৌশলগত অবস্থান ও প্রভাব বাড়াতে ভারত ও চীন ভুটানকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে।

আলোপ-আলোচনার পর গত অক্টোবরে ভুটান ও চীনের মধ্যে একটি ‘সহযোগিতা চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়েছে। তাদের এ চুক্তি ভারতের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারত দীর্ঘদিন ধরে ভুটানকে ‘বাফার স্টেট’ (প্রভাবশালী দুই রাষ্ট্রের মাঝখানে দুর্বল রাষ্ট্র) হিসেবে বিবেচনা করে আসছে।

লন্ডনের কিংস কলেজের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক হার্শ ভি পন্ত বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে ভুটান হচ্ছে ‘শেষ ধাপের কয়েকটি বাধার একটি’।

ভারত এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব আর বাড়তে দিতে চায় না। তারা এ অঞ্চলকে নিজের প্রভাববলয়ের বলে মনে করে থাকে। সুতরাং বাংলাদেশ, নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কাসহ এই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে বেইজিংয়ের ঋণ ও নানা চুক্তির বিষয়ে নয়াদিল্লি বেশ সতর্ক দৃষ্টি রাখছে।

থিম্পু ও বেইজিংয়ের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। অন্যদিকে ভারত ২০০৭ সাল পর্যন্ত ভুটানের বিদেশনীতি কার্যকরভাবে দেখভাল করে আসছিল।

থিম্পু ও বেইজিংয়ের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। অন্যদিকে ভারত ২০০৭ সাল পর্যন্ত ভুটানের বিদেশনীতি কার্যকরভাবে দেখভাল করে আসছিল।
যুক্তরাজ্যের চিন্তক প্রতিষ্ঠান চাথাম হাউস গত ডিসেম্বরে এক প্রতিবেদনে লিখেছিল, ‘অবাধ বাণিজ্য ও নিরাপত্তাব্যবস্থার’ বিনিময়ে ভারত-ভুটানের ওই সম্পর্ক বজায় ছিল।

প্রতিবেদনে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তোলা কিছু ছবি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ভুটানের উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্তে চীনের ‘অননুমোদিত নির্মাণকাজের’ বিষয়টিও ছবিতে স্থান পেয়েছে। এ অঞ্চলে নির্মাণকাজ হলে ‘এই ভূখণ্ড স্থায়ীভাবে চীনের’ হয়ে যেতে পারে। এ কারণে দুই দেশের সীমান্ত চুক্তি অনেক দিন ধরে মুলতবি অবস্থায় ছিল।

চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক বিবৃতির মাধ্যমে বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ভুটানের সঙ্গে সীমান্ত ইস্যুর দ্রুত সমাধান এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে চীন বদ্ধপরিকর।

সুদূরপ্রসারী প্রভাব

চাথাম হাউস বলেছে, বেইজিংয়ের ধারণা, একটি চুক্তির ফলে ভুটানের উত্তরাঞ্চলে তাদের অবস্থান সংহত হবে। পাশাপাশি ভুটানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং থিম্পুকে চীনের বলয়ে আনার সুযোগ আসতে পারে।

পন্ত বলেছেন, বেইজিং-থিম্পু যেকোনো চুক্তি ভারতের জন্য সুদূরপ্রসারী প্রভাব হয়ে উঠতে পারে।

পন্ত আরও বলেন, বেইজিং যদি এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে সফল হয় যে ‘ভারত এখন তার প্রতিবেশী হিসেবে তুলনামূলক প্রান্তিক শক্তি’, তবে তার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী।

দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে ভুটান হচ্ছে ‘শেষ ধাপের কয়েকটি বাধার একটি
’—অধ্যাপক হার্শ ভি পন্ত, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, লন্ডনের কিংস কলেজ

নয়াদিল্লি বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তি এবং দুই দেশের ৩ হাজার ৫০০ কিলোমিটার (২ হাজার ১৭৫ মাইল) দীর্ঘ সীমান্ত নিয়ে সতর্ক। এ সীমান্ত বারোমাসি উত্তেজনার একটি বড় উৎস।

২০১৭ সালে চীন-ভারত-ভুটান সীমান্তবর্তী বিতর্কিত ডোকলাম মালভূমির দিকে চীনা সৈন্যরা অগ্রসর হলে ভারত ও চীনের মধ্যে ৭২ দিনের সামরিক অচলাবস্থা দেখা দিয়েছিল। এই মালভূমি দক্ষিণে ‘চিকেন নেক’ নামে পরিচিত ভারতের শিলিগুড়ি করিডরের দিকে চলে গেছে।

দুই পাশে বাংলাদেশ ও নেপাল। মাঝখান দিয়ে বিপজ্জনকভাবে সরু লম্বালম্বি ভূখণ্ড ‘চিকেন নেক’ দিয়ে ভারতের মূল অংশের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর যোগাযোগ।

১৯৬২ সালে চীন ও ভারতের মধ্যে এ অঞ্চলে প্রায় এক মাস যুদ্ধ হয়েছিল।
চাথাম হাউস বলছে, ভুটানের উত্তরাঞ্চলে সীমান্ত চিহ্নিত করে চুক্তি হয়ে গেলে ভুটানের পশ্চিমাঞ্চলের দিকে চীনের দৃষ্টি যেতে পারে, যেখানে ডোকলাম মালভূমিসহ কিছু এলাকা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।

পন্ত বলছেন, চীনের তুলনায় খুবই ছোট ভুটানের জন্য এমন একটি চুক্তি অনেক বড় ব্যাপার। তিনি আরও বলেন, ‘এখনই যদি ভুটান সীমান্ত বিরোধের মীমাংসা না করে, ভবিষ্যতে তারা আরও বড় বেকায়দায় পড়ে যেতে পারে।’

গভীর উদ্বেগ

ভারতের সংবাদপত্র দ্য হিন্দুর কূটনৈতিক বিভাগের প্রধান সুহাসিনী হায়দার বলছিলেন, চীন-ভুটান সীমান্ত চুক্তি ‘অত্যাসন্ন মনে হচ্ছে’, যা ভারতের জন্য বেশ উদ্বেগের বটে।
সুহাসিনী বলেন, ২০১৭ সালে ডোকলাম নিয়ে অচলাবস্থা সৃষ্টির পর চীনের সঙ্গে আলোচনায় ভুটানের ‘সবচেয়ে অগ্রাধিকার’ ছিল সীমান্ত বিরোধ ইস্যু। ভুটানের এ সিদ্ধান্ত ‘ভারতের জন্য গভীর উদ্বেগের’ বটে।

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
ফাইল ছবি এএফপি

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ভুটানের ভোটারদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রনীতির ভূমিকা খুব একটা থাকে না। ইউরোপের দেশ সুইজারল্যান্ডের আয়তনের একটি দেশ, যেখানকার আট লাখ জনসংখ্যার প্রধান চিন্তা বেকারত্ব। আর তরুণদের মধ্যে বিদেশে অভিবাসী হওয়ার প্রবণতা বেশি।

অবশ্য ভুটানের বিনিয়োগ ও অবকাঠামোর সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে ভারত। সুতরাং দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সুহাসিনী বলেন, যেকোনো সরকারই ক্ষমতায় আসুক, তারা সম্পর্ক সুদৃঢ় করার চেষ্টা করবে।

বিশ্বব্যাংকের মতে, ভারতের সঙ্গে ভুটানের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে তাদের বাণিজ্যিক অংশীদার, বিদেশি সহায়তার উৎস, আর্থিক সহায়তাকারী ও তাদের অতিরিক্ত জলবিদ্যুৎ কেনার ক্ষেত্রে ভারত বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

গত ডিসেম্বরে ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক ভারতের সীমান্তে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন।

দুই পক্ষই আশাবাদী। ভুটানের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী প্রার্থীরা আগ্রহের সঙ্গে নয়াদিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের কথা বলেছেন। বিশেষ করে দিল্লির অংশীদারত্বে ভুটানের ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনীতিকে আরও এগিয়ে নিতে আগ্রহী তাঁরা।

ভারত ইতিমধ্যে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে ভুটানের সঙ্গে রেললাইন স্থাপনসহ একগুচ্ছ প্রকল্পের ঘোষণা দিয়েছে। তবে ভারতের বিনিয়োগকারীদের ওপর এর অনেকখানি নির্ভর করছে।

সুহাসিনী বলেন, ভুটান অন্যান্য দেশ থেকেও বিনিয়োগ চাইবে। থিম্পু যদি চীন থেকে বিনিয়োগকে স্বাগত জানায়, তাহলে সেটা হবে ‘গুরুত্বপূর্ণ’।