‘আমি অনেকের মরদেহ দেখেছি, ১৭ বার পরাঘাত অনুভব করেছি’

ভূমিকম্পে আহত একজনকে স্ট্রেচারে করে হেলিকপ্টার থেকে নামিয়ে আনেন স্বেচ্ছাসেবক ও আফগান নিরাপত্তাকর্মীরা। কুনার প্রদেশ, আফগানিস্তান, ১ সেপ্টেম্বরছবি: এএফপি

আফগানিস্তানের কুনার প্রদেশ। রোববার মধ্যরাতের একটু আগে। নিজ বাড়িতে ঘুমিয়ে ছিলেন মতিউল্লাহ শাহাব। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় তাঁর। জেগে দেখেন ঘরবাড়ি কাঁপছে। বুঝে যান, ভূমিকম্প হচ্ছে।

পরে জানা যায়, আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলজুড়ে আঘাত হানা ওই ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল রিখটার স্কেলে ৬। জাতিসংঘ জানিয়েছে, এতে নিহত হয়েছে প্রায় ১১শ মানুষ।

মতিউল্লাহ শাহাবের বাড়ি কুনার প্রদেশের আসাদাবাদ গ্রামে। গ্রামটি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল থেকে ১৬ কিলোমিটার বা প্রায় ১০ মাইল দূরে। তাঁর পরিবারের ২৩ জন সদস্য। ওই রাতে সবাই যাঁর যাঁর শোবার ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। ভয় পেয়েছিলেন, হয়তো দেয়াল ভেঙে তাঁদের ওপর পড়তে পারে। পরে পুরো রাত তাঁদের বাগানে কাটে। শাহাব বলেন, ‘আমরা সবাই ভয় পেয়েছিলাম।’

ভূমিকম্পে আফগানিস্তানের কুনার ও নানগারহার প্রদেশ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে বহু দূরে রাজধানী কাবুল থেকেও কম্পন অনুভূত হয়েছে। প্রতিবেশী পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদেও ভূকম্পন হয়েছে।

মতিউল্লাহ শাহাবের বাড়ি কুনার প্রদেশের আসাদাবাদ গ্রামে। গ্রামটি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল থেকে ১৬ কিলোমিটার বা প্রায় ১০ মাইল দূরে। তাঁর পরিবারের ২৩ জন সদস্য। ওই রাতে সবাই যাঁর যাঁর শোবার ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসেন। ভয় পান, হয়তো দেয়াল ভেঙে তাঁদের ওপর পড়তে পারে। পরে পুরো রাত বাগানে কাটে তাঁদের।

মতিউল্লাহ শাহাব পেশায় ফ্রিল্যান্স (স্বাধীন) সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী। ভোরের আলো ফোটার পর তিনি গাড়ি চালিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। গন্তব্য ছিল ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ও আশপাশের প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকা।

রাস্তায় বড় বড় পাথর পড়ে ছিল। এ কারণে একপর্যায়ে শাহাবকে গাড়ি থেকে নেমে যেতে হয়। পরে ঘণ্টা দুই হেঁটে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলোয় পৌঁছান।

শাহাব যখন আন্দারলাচক গ্রামে পৌঁছান, দেখেন, রাস্তার পাশেই কয়েকটি ছোট শিশুকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। দুটি ছোট শিশু স্ট্রেচারে একসঙ্গে শুয়ে রয়েছে। দুজনের বুকে ও মুখে আঘাতের ছাপ।

সেখানে সাদা কাপড়ে মোড়ানো শিশুর মরদেহ দেখেছেন শাহাব। ভূমিকম্পের আঘাতে ওই এক গ্রামেই প্রায় ৭৯ জন নিহত হয়েছেন বলে জানান এ সাংবাদিক। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘আমি অনেকের মরদেহ দেখেছি। ১৭ বার পরাঘাত অনুভব করেছি।’

গ্রামবাসীকে কবর খুঁড়তে সহায়তা করেছেন শাহাব। বলেন, ‘আমি যে গ্রামটিতে গেছি, সেটা প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে।’ স্থানীয় একজন তাঁকে বলেছেন, ভূমিকম্পে তাঁর স্ত্রী ও চার সন্তানের প্রাণ গেছে।

গ্রামবাসীর করুণ অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে শাহাব বলেন, ‘সবার মুখে, শরীরে ধুলোবালি লেগে রয়েছে। কারও মুখে কথা নেই। সবাই যেন রোবট হয়ে গেছেন। এ বিষয়ে (ভূমিকম্প) কেউ কিছু বলছেন না।’

অনেক জায়গায় সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তালেবান প্রশাসনের উদ্ধারকাজ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। অনেক পার্বত্য এলাকায় হেলিকপ্টার দিয়ে উদ্ধারকাজ চালানো হচ্ছে। অনেক জায়গায় এখনো উদ্ধারকারী দলের পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এমন অনেক জায়গা থেকে খবর আসছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে অনেকে আটকা পড়ে আছেন। তাঁদের দ্রুত সহায়তা দরকার।

অনেক জায়গায় সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তালেবান প্রশাসন উদ্ধারকাজে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। অনেক পার্বত্য এলাকায় হেলিকপ্টার দিয়ে উদ্ধারকাজ চালানো হচ্ছে। অনেক জায়গায় এখনো উদ্ধারকারী দলের পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এমন অনেক জায়গা থেকে খবর আসছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো অনেকে আটকা পড়ে আছেন। তাঁদের দ্রুত সহায়তা দরকার।

ভূমিকম্পে আহত একজনকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাচ্ছেন কয়েকজন। জালালাবাদ বিমানবন্দর, আফগানিস্তান, ১ সেপ্টেম্বর
ছবি: রয়টার্স

শাহাব বলেন, উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংসস্তূপে আটকে থাকাদের বের করে আনতে প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। তিনি নিজেও দুই নারীকে বাড়ির ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার হতে দেখেছেন। এ বিষয়ে শাহাব বলেন, ‘উদ্ধারকর্মীরা তাঁদের বের করে এনেছেন। তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।’ যদিও উদ্ধার কার্যক্রমের ছবি তোলার অনুমতি পাননি শাহাব। কেননা, তালেবান কখনোই নারীদের ছবি তোলা সমর্থন করে না।

শাহাব বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোয় এখনো অনেকে খোলা আকাশের নিচে রয়েছেন। তাঁদের তাঁবু দরকার।

আরও পড়ুন

কুনার প্রদেশের সোকাই জেলার অধিবাসী এজ্জাতুল্লাহ সাফি জানান, ভূমিকম্পে তাঁর বাড়ির একাংশ গুঁড়িয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘চিৎকারে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। কম্পনটি বেশ তীব্র ছিল। রাতটা যেন সর্বনাশের অনুভূতি নিয়ে এসেছিল।’

সাফি আরও বলেন, ‘ভূমিকম্পের পর প্রবল বাতাস হয়েছে। হালকা বৃষ্টিও। চারপাশ ধুলায় ছেয়ে গেছে। আমার শিশুসন্তানেরা আমাকে জড়িয়ে ধরে ভয়ে কাঁদছিল।’

আরও পড়ুন

সাফি বলেন, ‘ভূমিকম্পের পর মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমরা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বিদ্যুৎ নেই—এ অবস্থায় মুঠোফোনের আলোয় রাত পার করেছি।’

সকালে সরকারি হেলিকপ্টার আসে। প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকাগুলো থেকে আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে শুরুতে কুনারের প্রধান মহাসড়কে নিয়ে যায়। সেখান থেকে সড়কপথে তাঁদের বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয় বলে জানান সাফি।

সাফি বলেন, এলাকায় শোকের আবহ। বিদ্যুৎ নেই। বাজার, দোকানপাট বন্ধ। কিছু জায়গায় এখনো পৌঁছানো যায়নি; বিশেষ করে প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামগুলোতে। সেখানে যেতে ৫–৬ ঘণ্টা লেগে যায়।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন