ব্যাংক লুটেরা সেই ধনকুবের নারী আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন

প্রসাধনীর দোকানদার থেকে ধনকুবের বনে যাওয়া নারী ট্রুং মাই ল্যানছবি: এএফপি

মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ভিয়েতনামের ধনকুবের ৬৭ বছর বয়সী নারী ট্রুং মাই ল্যান আত্মহত্যা করার কথা ভেবেছিলেন। রায় ঘোষণার আগে গত সপ্তাহে  অধস্তন ব্যক্তিদের দোষারোপ করে নিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করার পর আদালতকে আত্মহত্যার ভাবনার কথা জানিয়েছেন।

গত বৃহস্পতিবার হো চি মিন সিটির ঔপনিবেশিক যুগের একটি আদালত আবাসন ব্যবসায়ী এই নারীকে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি ক্ষতিপূরণ ও কারাদণ্ডের আদেশ দেন।  প্রায় ২৯৬ কোটি ১৭ লাখ টাকা (২ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার) ক্ষতিপূরণ দিতে হবে তাঁকে। এ ছাড়া ঘুষ ও ব্যাংক ঋণের নিয়ম লঙ্ঘনের জন্য অতিরিক্ত ২০ বছরের কারাদণ্ডাদেশও দিয়েছেন আদালত। ১১ বছর ধরে দেশটির বড় একটি ব্যাংক থেকে কোটি কোটি ডলার লুট করার দায়ে তাঁকে এই সাজা দেওয়া হয়। তবে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার জন্য ১৫ দিন সময় পেয়েছেন তিনি।

বলা হচ্ছে, এটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনা। আর এই বিচারকাজ ভিয়েতনামে অনুষ্ঠিত সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে গত ৫ মার্চ এই মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। আর রায় ঘোষণা করা হলো গতকাল শুক্রবার।

আদালতে ট্রুং বলেন, ‘আমি হতাশার মধ্যে পড়ে গেছি। এ কারণে আমি আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলাম। ব্যাংকিং সেক্টর সম্পর্কে আমার জ্ঞান খুব কম। এর সঙ্গে জড়িত হওয়া আমার বোকামি ছিল।’

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভিয়েতনামের অভিজাত রিয়েল এস্টেট কোম্পানি ভান থিন ফাট হোল্ডিংস গ্রুপের চেয়ার ওম্যান ট্রুং মাই ল্যানের বিরুদ্ধে দেশটির সাইগন কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে ৪ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। এই মামলায় ২০২২ সালের অক্টোবরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। সে সময় থেকেই তিনি কারাগারে আছেন। আইনজীবীরা বলেন, ঋণের ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলার পুনরুদ্ধার হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এই মামলায় ২ হাজার ৭০০ জনকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ডাকা হয়েছিল এবং রাষ্ট্রপক্ষে ১০ জনসহ মোট ২০০ আইনজীবী ছিলেন।

মজার ব্যাপার হলো, এই মামলার প্রমাণ মোট ১০৪টি বাক্সে সংরক্ষিত আছে, যার ওজন ৬ টন। এই মামলায় ট্রুংসহ মোট ৮৫ জনের বিচার চলছে। যাঁরা সবাই নিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁরা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারেন।

হো চি মিন সিটির ঔপনিবেশিক যুগের একটি আদালতে রায় ঘোষণার সময় ট্রুং মাই ল্যান
ছবি: এএফপি

টাইম ডটকমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অপরাধী ট্রুংসহ ৮৫ জনের মধ্যে তাঁর ব্যবসায়ী স্বামী এরিক চু নাপ-কি, ভাতিজি ভান থিন ফাটের সাবেক সিইও ট্রুং হুই ভান, ঘনিষ্ঠ স্বজন, গাড়িচালক, সাইগন কমার্শিয়াল ব্যাংকের ৩ নির্বাহীসহ ৪৫ জন কর্মী, ভিয়েতনাম স্টেট ব্যাংকের সাবেক ১৫ কর্মকর্তা, ৩ জন সরকারি পরিদর্শক ও স্টেট অডিট অফিসের এক কর্মকর্তা আছেন।

আদালতে আসামিদের সবাইকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে চারজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও অন্যদের শর্তসাপেক্ষে ৩ থেকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ট্রুং মাই ল্যানের স্বামী এরিকের ৯ বছর ও ভাতিজি ট্রুং হুই ভানের ১৭ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ট্রুংয়ের পরিবারের এক সদস্য রয়টার্সকে বলেছেন, ‘এ বিষয়ে আমরা কী করতে পারি, তা দেখার জন্য লড়াই চালিয়ে যাব।’ রায় ঘোষণার আগে তিনি বলেছিলেন যে সাজার বিরুদ্ধে আপিল করবেন ট্রুং।

ট্রুংয়ের এক আইনজীবী নগুয়েন হুই থিয়েপ রয়টার্সকে বলেন, ‘ট্রুং অর্থ আত্মসাৎ ও ঘুষের অভিযোগে দোষী নন বলে আদালতকে জানিয়েছেন। তবু তাঁকে আত্মসাতের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড এবং ঘুষ ও ব্যাংকিং বিধি লঙ্ঘনের দায়ে ক্ষতিপূরণসহ ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অবশ্যই তিনি এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন।’

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ভিয়েতনামে দীর্ঘদিন কাজ করা মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডেভিড ব্রাউন বলেছেন, ‘আমার মনে হয়, কমিউনিস্ট শাসনামলে এ রকম বিচার আগে কখনো হয়নি। আগে এ ধরনের ঘটনাও (অপরাধ) ঘটেনি।’

বলা হচ্ছে, কমিউনিস্ট দলের সাধারণ সম্পাদক নগুয়েন ফু ট্রংয়ের নেতৃত্বে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে এখন পর্যন্ত এই বিচারকাজ সবচেয়ে নাটকীয়।

নগুয়েন ফু ট্রং মনে করেন, চরম দুর্নীতির কারণে জনগণের ক্ষোভ কমিউনিস্ট দলের একচেটিয়া ক্ষমতার জন্য হুমকি। তিনি ২০১৬ সালে তৎকালীন ব্যবসাবান্ধ প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করেন। এই অভিযানের অংশ হিসেবে দুজন প্রেসিডেন্ট ও দুই উপপ্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। শতাধিক কর্মকর্তাকে কারাগারে যেতে হয়েছে। এখন তাঁদের দলে ঢুকলেন ধনকুবের এই নারী।

ট্রুং মাই ল্যান হো চি মিন সিটির একটি সিনো-ভিয়েতনামি পরিবার থেকে এসেছেন। আগে এই এলাকা সাইগন নামে পরিচিত ছিল। দীর্ঘদিন এই এলাকা ভিয়েতনামের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি ছিল। কমিউনিস্টবিরোধী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী–অধ্যুষিত এলাকা ছিল সাউথ ভিয়েতনাম। সেখানেই বেড়ে ওঠা ট্রুংয়ের।

ভিয়েতনামের বড় একটি ব্যাংক থেকে কোটি কোটি ডলার লুটের অভিযোগে ট্রুংয়ের মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেছেন আদালত
ছবি: এএফপি

মায়ের সঙ্গে প্রসাধনীর ছোট্ট দোকান দিয়ে ট্রুং জীবন শুরু করেছিলেন। ১৯৮৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টি অর্থনৈতিক সংস্কারের সূচনা করার পর জমি ও সম্পত্তি কেনা শুরু করেছিলেন, যা ডোই মোই নামে পরিচিত। ১৯৯০-এর দশকে তিনি একটি বড় হোটেল ও রেস্টুরেন্টের মালিক হন। সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এরপর ১৯৯২ সালে তিনি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি ভান থিন ফাট (ভিটিপি) প্রতিষ্ঠা করেন। একই বছরে এরিক চুকে বিয়েও করেন তিনি।

বিবিসির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অন্যান্য ধনী ব্যক্তির মতোই ট্রুং জমি ও আবাসন ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল আয় করতে থাকেন। রাষ্ট্রীয় বড় বড় কর্মকর্তার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের সুবিধা নিয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জমি ব্যবহারের সুবিধা নেন ট্রুং।

২০১১ সাল পর্যন্ত ট্রুং মাই ল্যান হো চি মিন সিটির সুপরিচিত ব্যবসায়ী ছিলেন। পরে তাঁকে তিনটি ছোট ব্যাংককে একটি বৃহত্তর সত্তায় একীভূত করার ব্যবস্থার অনুমতি দেয় সাইগন কমার্শিয়াল ব্যাংক।

ভিয়েতনামের আইনে যেকোনো ব্যাংকে ৫ শতাংশের বেশি শেয়ার থাকার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ রয়েছে। কিন্তু সরকারি কৌঁসুলিরা বলেন, শত শত শেল কোম্পানি ও তার প্রক্সি হিসেবে কাজ করা ব্যক্তির মাধ্যমে ট্রুং আসলে সাইগন কমার্শিয়াল ব্যাংকের ৯০ শতাংশের বেশি শেয়ারের মালিক ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের লোকদের ব্যবস্থাপক হিসেবে নিয়োগ দেন তিনি। এরপর নিজের নিয়ন্ত্রণ করা শেল কোম্পানির নেটওয়ার্কে শত শত ঋণ অনুমোদন করার জন্যও আদেশ দেওয়ার অভিযোগ ছিল এই নারীর বিরুদ্ধে।

ট্রুং গাড়িচালককে দিয়ে ব্যাংক থেকে নগদ চার বিলিয়ন মার্কিন ডলার তুলে বেজমেন্টে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ভিয়েতনামের সবচেয়ে বড় অঙ্কের ব্যাংক নোটে এই পরিমাণ অর্থের ওজন দুই টন
ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

আইনজীবীদের মতে, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে তিন বছরের মধ্যে তিনি তাঁর গাড়িচালককে দিয়ে ব্যাংক থেকে নগদ ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার (১০৮ ট্রিলিয়ন ভিয়েতনামি ডং) তুলে তাঁর বেজমেন্টে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ভিয়েতনামের সবচেয়ে বড় অঙ্কের ব্যাংক নোটে এই পরিমাণ অর্থের ওজন দুই টন।

আরও পড়ুন

ট্রুং যে ঋণ নিয়েছেন, তা কখনো যাচাই-বাছাই করা হয়নি। ঋণ যাচাই-বাছাই না করার জন্য বড় অঙ্কের ঘুষ দিতেন তিনি। এ ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন হলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান পরিদর্শক। বর্তমানে তিনি ৫০ লাখ ডলার ঘুষ নেওয়ার অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ পেয়েছেন।