আফগানিস্তানে আটকা দোভাষীরা কেমন আছেন?

যুক্তরাষ্ট্রের এক সেনাসদস্যের সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছেন এক আফগান দোভাষী
ফাইল ছবি: রয়টার্স

আফগানিস্তানে ১১ দোভাষীর দিন কাটছে আতঙ্কে। বিগত ২০ বছরে আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে তাঁরা কাজ করেছেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হয়ে। তাঁদের অভিযোগ, যুক্তরাজ্য কথা রাখেনি। তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর তাঁদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দিলেও পরে আর তাঁদের নেওয়া হয়নি।

১১ আফগান দোভাষীর সঙ্গে কথা বলেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। তাঁরা  জানান, অন্যদের মতো তাঁরাও যুক্তরাজ্য সরকারের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছিলেন। দেশটিতে পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে যোগ্যদের তালিকায় তাঁরা রয়েছেন বলে জানানো হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত বাদ পড়েন তাঁরা। বলা হয়, নিরাপত্তা বিবেচনায় তাঁদের সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়েছে। এই ১১ দোভাষীর মধ্যে কয়েকজনের কথা তুলে ধরা হলো এখানে।

‘জানি না কোথায় যাব’

আফগানিস্তানের হেলমান্দ প্রদেশে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হয়ে দোভাষীর কাজ করতেন আবদুল (ছদ্মনাম)। চলতি বছরে তালেবান আফগানিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চল দখল করা শুরু করলে ঘাবড়ে যান তিনি। তালেবানের নিশানায় পড়ার আশঙ্কা ছিল তাঁর।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে জুলাইতে যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পান আবদুল। বলা হয়, তাঁকে দেশটিতে পুনর্বাসন করা হবে। দুই সপ্তাহের মধ্যে তাঁকে নিয়ে আফগানিস্তান ছাড়বে একটি ফ্লাইট। এমন নির্দেশনা পেয়ে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন আবদুল। বিক্রি করে দেন বেশির ভাগ সম্পত্তি। চাকরি ছাড়ার দিকেও এগোচ্ছিলেন।

তবে দুঃসংবাদ আসে ১১ আগস্ট। সে সময় তালেবান যখন কাবুল জয়ের একেবারে দ্বারপ্রান্তে, তখন একটি চিঠি আসে আবদুলের হাতে। বলা হয়, ‘জাতীয় নিরাপত্তার’ কারণে তাঁর ভিসা আবেদন বাতিল করা হয়েছে। বিষয়টি নতুনভাবে বিবেচনা করারও কোনো সুযোগ নেই।

ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ছাড়াও আবদুল কাজ করেছেন জাতিসংঘের হয়ে। জাতিসংঘের হয়ে তাঁর কাজে কোনো অসংগতি পাওয়া যায়নি বলে সংস্থাটির এক মুখপাত্র বিবিসিকে জানিয়েছেন। আবদুলের কাজের প্রশংসা করেছেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তাও। তারপরও কেন এমন হলো, তা জানেন না আবদুল। তিনি বলেন, ‘আমি কখনো কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়াইনি। আমি ব্রিটিশ সেনাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছি।’

শুধু নিজেকে নিয়েই না, আবদুলের ভয় তাঁর পরিবারকে নিয়েও। তিনি বলেন, ‘দুশ্চিন্তা আমাকে নিয়ে না। আমি ভয় পাচ্ছি আমার সন্তানদের নিয়ে। তারা স্কুল থেকে আদৌ ফিরবে কি না, তা নিয়ে প্রতিদিন শঙ্কার মধ্য থাকি।’

এদিকে তালেবান ঘরে ঘরে তল্লাশি চালাচ্ছে এমন গুজবের মুখে আগস্টের শেষের দিকে কাবুলে পাড়ি জমান আবদুল। তাঁর ভাষ্য, এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে সবকিছু করার চেষ্টা করছেন তিনি। তবে জানেন না কোথায় যাবেন।

তালেবান কাবুল দখলের পর আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় হুমকির মুখে থাকা আফগানদের
ফাইল ছবি: রয়টার্স

‘কী পাপ করেছি আমি’

আবদুলের মতো আরেক দোভাষী সায়েদ (ছদ্মনাম)। তাঁর অবস্থাও বেশ করুণ। এককালে যুক্তরাজ্যের হয়ে কাজ করা এই ব্যক্তিটি এখন তালেবানের ভয়ে লুকিয়ে থাকেন বাড়ির পেছনের একটি জঙ্গলে। পরিবারের জন্য খাবার কিনতে সপ্তাহে এক দিন গভীর রাতে শহরে যান তিনি।

ব্রিটেনের হয়ে কাজ করার দায়ে এক দশক আগে তালেবানের কাছ থেকে একটি হুমকির চিঠি পান সায়েদ। সেখানে লেখা ছিল, ‘অবিশ্বাসীদের হয়ে কাজ করার জন্য তাঁর শাস্তি হবে।’ এরপর থেকেই নানা শঙ্কায় ছিলেন তিনি।

এ থেকে মুক্তি পেতে যুক্তরাজ্যে পুনর্বাসনের জন্য আবেদন করেছিলেন সায়েদ। এপ্রিলে জানানো হয়, তিনি যুক্তরাজ্য যাওয়ার যোগ্য। পরে আগস্টে এসে সিদ্ধান্ত বদলায় যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। কারণটা আবদুলের মতোই। সায়েদকে বলা হয়, তিনি দেশটির নিরাপত্তার জন্য হুমকি ডেকে আনবেন।

সায়েদ বলেন, ‘ব্রিটিশদের সঙ্গে কাজ করাই কি আমার পাপ? আমি কোনো অপরাধ করিনি। আমি অপরাধী নই। আমি অবৈধ কিছুই করিনি।’

এখনো আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সায়েদ। তিনি বলেন, ‘আমাদের এবং সন্তানদের ভাগ্য নিয়ে আমি এখনো আশাবাদী। তবে ভয় হয়, এই লোকগুলো (তালেবান) আমাকে খুঁজে বের করবে।’

‘আমার ঘুম আসত না’

আবদুল ও সায়েদের মতো একই পরিণতি হয়েছিল আলীরও (ছদ্মনাম)। পুনর্বাসনের আশ্বাস দিয়ে পরে তাঁকেও ফিরিয়ে দিয়েছিল যুক্তরাজ্য। তবে আলীর ভাগ্য কিছুটা সুপ্রসন্ন। যুক্তরাজ্য মুখ ফিরিয়ে নিলেও ডেনমার্কে আশ্রয় পেয়েছেন তিনি। এখন পরিবারের সঙ্গে বাস করছেন পূর্ব ডেনমার্কের একটি শহরে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর পাশাপাশি ডেনমার্কের হয়েও কাজ করতেন আলী।

যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে আশ্বাস পেয়ে হেলমান্দ প্রদেশের বসতবাড়ি বিক্রি করে দিয়েছিলেন আলী। এরপর প্রতিদিন সকালে ই-মেইল খুলে দেখতেন। অপেক্ষায় থাকতেন কখন যুক্তরাজ্য পাড়ি দেওয়ার ডাক আসবে। একদিন সকালে ই-মেইল এসেছিল। তবে ভিন্ন খবর নিয়ে। মেইল খুলে আলী জানতে পারেন, তাঁর আবেদন শেষ মুহূর্তে এসে খারিজ করে দিয়েছে যুক্তরাজ্য সরকার।

আলী বলেন, ‘আমি চার-পাঁচ দিন ঘুমাতে পারিনি। নিজের কাছে শুধু জিজ্ঞাসা করতাম, তারা কেন এমন সিদ্ধান্ত নিল।’ তাঁর ভাষ্য, যুক্তরাজ্য তাঁর মধ্যে কী এমন হুমকির কারণ খুঁজে পেল, যা ডেনমার্ক পায়নি।

তালেবাননিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানে হুমকির মুখে আছেন অনেক বাসিন্দা
ফাইল ছবি: রয়টার্স

‘ওরা আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাবে’

যুক্তরাজ্যের আশ্বাসে ৭ হাজার মার্কিন ডলার ধার নিয়েছিলেন আহমদ (ছদ্মনাম)। অনেক আশা ছিল, দেশটিতে গিয়ে নতুন করে সবকিছু শুরু করবেন তিনি। তবে একটি চিঠি সব তছনছ করে দিয়েছিল।

১৬ আগস্ট—তালেবানের কাবুল দখলের ঠিক পরদিন আহমদের কাছে চিঠিটি এসেছিল ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে। অন্য অনেকের মতো তাঁকেও জানানো হয়েছিল, নিরাপত্তার খাতিরে দেশটিতে আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে না তাঁকে।

সেদিনের ঘটনার স্মৃতিচারণা করে বিবিসিকে আহমদ বলেন, কেন এমনটা হয়েছিল তা জানেন না। তবে তিনি একজন পশতু। পশতুদের সঙ্গে তালেবানের সুসম্পর্ক রয়েছে। এ কারণে তিনি বাদ পড়তে পারেন।

যুক্তরাজ্যে আশ্রয়ের আশা ভঙ্গ হলেও থেমে যাননি আহমদ। জীবন বাঁচাতে পাকিস্তানে পাড়ি জমান তিনি। তবে সেখানেও শান্তি নেই তাঁর। বাইরে বের হতে ভয় পান। তিনি জানান, তালেবান তাঁর পরিবারের সদস্যদের হুমকি দিচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে কী করবেন তা জানেন না।

আহমদ বলেন, ‘আমি যখন আত্মসমর্পণ করব, তালেবান আমার ওপর নির্যাতন চালাবে, মারধর করবে। এরপর তারা হয় আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাবে, না হয় গুলি করে মারবে।’

‘ঘটনাগুলো বিরক্তির’

নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে আফগান দোভাষীদের এভাবে ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনাগুলোকে ‘বিরক্তিকর’ বলে উল্লেখ করেছেন কাবুলে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষাবিষয়ক সাবেক কর্মকর্তা সাইমন ডিগিনস। বর্তমানে তিনি দেশটির হয়ে কাজ করা আফগানদের অধিকার নিয়ে লড়ছেন।

সাইমন বলেন, ‘আমাদের এই প্রক্রিয়ার ওপর কোনো আস্থা নেই। দোভাষীদের বিরুদ্ধে আনা প্রমাণ সামনে আনা হয়নি। প্রমাণের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করারও কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। এমনকি এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো আবেদনও করা যাবে না।’

এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি যুক্তরাজ্য সরকার। তাদের এক মুখপাত্র বিবিসিকে বলেন, ‘আফগানিস্তানে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা আমাদের জাতীয় ও জননিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি ডেকে আনতে পারে। এ কারণেই সরকার, আমাদের আন্তর্জাতিক মানের গোয়েন্দা সংস্থা এবং অন্যরা সবকিছুর বিশদ নিরীক্ষা করে দেখেন। যদি কাউকে আমাদের দেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়, তাহলে আমরা ব্যবস্থা নেব।’

এদিকে যেসব দোভাষীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, তাঁদের আপিল করার সুযোগ দেওয়া উচিত বলে মনে করেন যুক্তরাজ্যের লেবার দলের এমপি ডায়েন অ্যাবোট। তিনি বলেন, ‘অভিবাসনপ্রত্যাশীদের প্রথমে গ্রহণ করা এবং পরে তাঁদের ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি অনেক পুরোনো। এর পেছনে হয়তো কারণ থাকতে পারে। তবে এ বিষয়ে অন্তত স্বচ্ছতা রাখা সরকারের দায়িত্ব। পাশাপাশি তাঁদের আপিল করারও সুযোগ দেওয়া উচিত।’