আফগানিস্তানে এত প্রাণ ও সম্পদ ধ্বংসের আদৌ প্রয়োজন ছিল

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা দিয়েছেন, আমেরিকার দীর্ঘতম যুদ্ধের সমাপ্তি টানার সময় এসেছে। দীর্ঘ দুই দশক পর আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হবে আগামী ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে। কিন্তু দেশটিতে কি টেকসই স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে? তাহলে দীর্ঘ দুই দশক ধরে এত প্রাণহানি ও সম্পদ নষ্টের আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল কি না, সেই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।

আল-কায়েদার আস্তানাকে টার্গেট করে তোরা বোরা পর্বতে মার্কিন বাহিনীর বোমা হামলা। তালেবানবিরোধী আফগান যোদ্ধারা সেই দৃশ্য দেখছেন। ১৬ ডিসেম্বর, ২০০১।
ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের মধ্যে সম্পাদিত শান্তি চুক্তি অনুযায়ী ১৪ মাসের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের কথা। সেই অনুযায়ী চলতি এপ্রিল মাস হয় ১৪তম মাস। তবে এর মধ্যে প্রত্যাহার করতে না পারলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ১৫ এপ্রিল ঘোষণা দেন ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাদের পুরোপুরি সরিয়ে নেওয়া হবে। ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি করা চুক্তির বাস্তবায়নে কিছু শর্ত ছিল। বলা হয়েছিল চুক্তি অনুযায়ী এই প্রত্যাহারের নির্ভর করবে ভবিষ্যতে তালেবানের আচরণ, আফগানিস্তানে সহিংসতার মাত্রা হ্রাস এবং তালেবান ও আফগান সরকারের মধ্যে সফল আলোচনার ওপরে।

পশ্চিম কাবুলে সাবেক সোভিয়েত দূতাবাস তখন আফগান শরণার্থীদের আশ্রয়শিবির। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে কেন্দ্রের দেয়াল। ২৭ নভেম্বর, ২০০১।
ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘতম আফগান যুদ্ধ অবসানের জন্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে বলেন, আমেরিকার দীর্ঘতম যুদ্ধের সমাপ্তি টানার সময় এসেছে। সময় এসেছে সেনাদের ঘরে ফিরিয়ে আনার। তালেবানের সঙ্গে যুদ্ধ করার চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আশু চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করাই এখন অগ্রাধিকার। তিনি বলেন, ‘আমি চতুর্থ প্রেসিডেন্ট হিসেবে আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা উপস্থিতি নিয়ে কথা বলছি। সমস্যাটিকে আমি আমার কোনো উত্তরসূরি প্রেসিডেন্টের জন্য রেখে যেতে চাই না।’

কিন্তু আদৌ কি দেশটিতে টেকসই স্থিতিশীল অবস্থা ফিরে এসেছে? দীর্ঘ দুই দশক ধরে আফগানিস্তানে মার্কিন জোট বাহিনীর অবস্থানের চড়া মূল্য সব পক্ষকেই দিতে হয়েছে। সেই মূল্য জীবন দিয়ে, যাপিত জীবনে ক্ষতি এবং অর্থমূল্যে শোধ করতে হয়েছে। দীর্ঘ এই সময়ে এত প্রাণহানি ও সম্পদ নষ্টের আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল কি না, সেই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
ফিরে দেখা

একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১, এই পাঁচ বছরে ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বে আফগানিস্তানে শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আল-কায়েদা। তারা সেখানে জঙ্গি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প বানিয়েছে। এমনকি কুকুরের ওপর বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাব পরীক্ষা করার সুযোগ পেয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ২০ হাজারের বেশি মানুষকে নিজেদের সংগঠনে ভিড়িয়ে এক একজনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে জঙ্গি হিসেবে গড়ে তুলেছে। সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশের তিন বছরের মাথায় ১৯৯৮ সালে আল-কায়েদা কেনিয়া ও তানজানিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে হামলা চালায়। ওই সব হামলায় ২২৪ জন নিহত হয়েছিল, যার বেশির ভাগই ছিল আফ্রিকার সাধারণ মানুষ।

মিয়ামি থেকে আসা এক মার্কিন সেনা যুদ্ধে কতজন সহযোদ্ধা হারিয়েছেন, পাথরের গায়ে দাগ কেটে সেই হিসাব রাখছেন। শেরখানখেইল, মার্জাক ও বোরেলকেইল, ৯ মার্চ, ২০০২।
ছবি: রয়টার্স

ওই সময়ে আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল আল-কায়েদা। ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে তালেবান। যুক্তরাষ্ট্র ওই সময় তাদের মিত্র সৌদি আরবের মাধ্যমে তালেবান সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে আফগানিস্তান থেকে আল-কায়েদাকে উৎখাতের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তালেবান সরকার তাতে সাড়া দেয়নি। কিন্তু ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তালেবান সরকারকে দায়ীদের তাদের হাতে তুলে দিতে বলেছিল। কিন্তু সেবারও তালেবান ওই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। এর উপযুক্ত জবাব দিতে আফগানিস্তানে অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনী।

তারপরের কয়েক মাসে আফগানিস্তানে তালেবানবিরোধী বাহিনী ‘দ্য নর্দান অ্যালায়েন্স’ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বাহিনীর সহায়তায় কাবুলে হামলা চালিয়ে তালেবান সরকারকে উৎখাত করে। আল-কায়েদা জঙ্গিরা পাকিস্তান সীমান্তে পালিয়ে যায়।

২০ বছরের ক্ষয়ক্ষতি
আফগানিস্তানে যুদ্ধ করতে এসে ২ হাজার ৩০০–এর বেশি মার্কিন সেনা নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ২০ হাজারের বেশি। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যের ৪৫০ জনের বেশি সেনা নিহত এবং অন্যান্য দেশেরও শতাধিক সেনা প্রাণ হারিয়েছেন। অন্যদিকে দীর্ঘ এ সময়ে ৬০ হাজারের বেশি আফগান সেনার প্রাণ গেছে। বেসামরিক মানুষ নিহতের সংখ্যা এরও প্রায় দ্বিগুণ।

আর অর্থের খরচ ছিল সীমাহীন। আফগানিস্তানে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের করদাতাদের প্রায় এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হয়েছে।

আফগান ন্যাশনাল আর্মির সঙ্গে যৌথ অভিযান চলার সময় আফগান এক শিশুর সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন কানাডিয়ান এক সেনা। কান্দাহার প্রদেশ, আফগানিস্তান, ১৩ জুলাই, ২০০৭।
ছবি: রয়টার্স

আশা–আশঙ্কা
যুক্তরাষ্ট্রের একজন জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, এরপর (মার্কিন জোট বাহিনীর অবস্থান) আফগানিস্তান থেকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি হামলার আর কোনো পরিকল্পনা সফল হয়নি। সে ক্ষেত্রে বলা যায়, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপের অংশ হিসেবে দেশটিতে পশ্চিমা সেনাবাহিনী এবং নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি তাদের লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়েছে।

কিন্তু এত কিছুর পরও দেশটিতে এখনো শান্তি আসেনি। গবেষণাকারী দল ‘অ্যাকশন অন আর্মড ভায়োলেন্স’ গ্রুপের তথ্যমতে, ২০২০ সালে বিশ্বের যেকোনো দেশের তুলনায় বিস্ফোরণে সবচেয়ে বেশি মানুষ আগানিস্তানে নিহত হয়েছেন। আল-কায়েদা, ইসলামিক স্টেট (আইএস) বা অন্যান্য জঙ্গিগোষ্ঠীর কোনোটিই সম্পূর্ণ নির্মূল হয়নি।

পশ্চিমা বাহিনীকে এখান থেকে পুরোপুরি সরিয়ে নিলে এই জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।

আফগানিস্তানে বিভিন্ন সময় সফর করা যুক্তরাজ্যের প্রধান প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা ইয়েট জেনারেল স্যার নিক কার্টার বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আফগানিস্তানে এমন একটি নাগরিক সমাজ তৈরি করেছে, যারা তালেবান কী ধরনের জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে তাদের বৈধতা চায়, সেই হিসাব পাল্টে দিয়েছে। দেশটি এখন ২০০১ সালের তুলনায় ভালো অবস্থানে আছে। এবং তালেবান এখন আগের তুলনায় অনেক উদার হয়েছে।’

তবে লন্ডনভিত্তিক এশিয়া প্যাসিফিক ফাউন্ডেশনের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাবিষয়ক পরিচালক ড. সজ্জন গোয়েল সেনা প্রত্যাহারের এ সিদ্ধান্তে অনেকে বেশি নিরাশ। তিনি বলেন, ‘সেখানে এখন সত্যিকারের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। আফগানিস্তান আবারও নব্বইয়ের দশকের মতো চরমপন্থীদের উৎসস্থলে পরিণত হতে পারে। পশ্চিমা নানা গোয়েন্দা সংস্থাও একই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

হেলমান্দ প্রদেশে তালেবান যোদ্ধাদের সঙ্গে মার্কিন বাহিনীর সম্মুখসারির যুদ্ধ। ১৮ মে, ২০০৮।
ছবি: রয়টার্স

গোয়েল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এখন সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণ নিতে আফগানিস্তানে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে বিদেশি সন্ত্রাসী যোদ্ধাদের ঢল নামবে। কিন্তু পশ্চিমারা এর বিরুদ্ধে আর কিচ্ছু করতে পারবে না, কারণ এরই মধ্যে তারা আফগানিস্তানকে ছেড়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শেষ করে ফেলবে।’

২০০৩ সালে বিবিসির সাংবাদিক ফিল গুলউইন আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ২০ বছরের মধ্যে তালেবান আবারও দক্ষিণের বেশির ভাগ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে।

আফগানিস্তানের অজ্ঞাত এক স্থানে অস্ত্র হাতে তালেবান জঙ্গিরা। ১৬ জানুয়ারি, ২০০৯।
ছবি: রয়টার্স

তবে হয়তো এটাই আফগানিস্তানের অনিবার্য পরিণতি নয়। বরং দেশটির ভবিষ্যৎ দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে। প্রথমত, ক্ষমতায় ফিরে যেতে পারলে তালেবান কি আবারও আল-কায়েদা ও আইএস জঙ্গিদের আফগানিস্তানে সক্রিয় হওয়ার এবং এলাকা দখল করার অনুমতি দেবে। দ্বিতীয়ত, আফগানিস্তানে না থেকেও সেখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রাখার যে চুক্তি করেছে, তা কতখানি বাস্তবায়ন হবে।

এখন তালেবান যখন আফগান রাজনীতিতে ভূমিকা রাখবে, ক্ষমতায় বসবে—তখন এত দিনের এত প্রাণ, রক্ত, অর্থ, অবকাঠামোগত ধ্বংসের আদৌ কি কোনো অর্থ দাঁড়ায়?