আলোচনায় বাগরাম ঘাঁটি

বিশাল এই বাগরাম ঘাঁটির অবস্থান কাবুলের ৪০ মাইল উত্তরে। এর নামকরণ কাছের একটি গ্রামের নামে। এটি ৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে অবস্থিত।

বাগরাম বিমানঘাঁটি থেকে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে এভাবেই উড়াল দিত মার্কিন যুদ্ধবিমান।ফাইল ছবি : রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সেনারা আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটি ছেড়েছেন। প্রায় দুই দশক পর বিদেশি সেনামুক্ত হলো আফগানিস্তানের সবচেয়ে বড় এ বিমানঘাঁটিটি। মার্কিন বাহিনীর আফগানিস্তানে প্রবেশের পর থেকে তাদের অভিযানের প্রায় সবকিছু নিয়ন্ত্রণ হতো বাগরাম ঘাঁটি থেকে। তখন থেকে বিশ্ব গণমাধ্যমে বহুল আলোচিত এই ঘাঁটি।

মার্কিন গণমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মতে, মার্কিন সৈন্যদের বাগরাম ঘাঁটি ছেড়ে যাওয়ার ঘটনাটি আফগানিস্তানের জন্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, সেনা প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে প্রায় দুই দশক ধরে চলা আফগান যুদ্ধের ইতি টানছে যুক্তরাষ্ট্র। আগস্টের শেষ নাগাদ সব বিদেশি সেনা আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার কথা।

সামরিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, কাবুলকে সুরক্ষিত রাখতে এবং তালেবানকে দূরে রাখতে আফগান সরকার কতটা সফল হয়, তা নির্ভর করবে দেশটির সরকার বাগরামের নিয়ন্ত্রণ কতটা বজায় রাখতে সক্ষম হয় তার ওপর।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, আগামী ১১ সেপ্টেম্বরের আগে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র সব সেনা প্রত্যাহার করবে। হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব জেন সাকি বলেছেন, আরও আগে অর্থাৎ আগস্টেই সব মার্কিন সেনা আফগানিস্তান ছেড়ে যেতে পারেন।

সেনা প্রত্যাহারের লক্ষ্যে জোরেশোরে কাজ চলছে। প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া অর্ধেকের বেশি সম্পন্ন হয়েছে বলে জানা গেছে। সেনা প্রত্যাহারের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র গত ১ মের আগেই ছয়টি সামরিক ঘাঁটি আফগান বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করে।

গত এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন, আমেরিকার দীর্ঘতম আফগান যুদ্ধের সমাপ্তি টানার সময় এসেছে।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ২০০১ সালে আফগান যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। একসময় ৯৩ হাজারের বেশি মার্কিন সেনার উপস্থিতি ছিল আফগানিস্তানে। এপ্রিলে বাইডেন যখন এই যুদ্ধ অবসানের লক্ষ্যে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন, তখন আফগানিস্তানে প্রায় ২ হাজার ৫০০ মার্কিন সেনা অবস্থান করছিলেন।

আলোচনায় বাগরাম ঘাঁটি

মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাগরাম ঘাঁটি আবারও আলোচনায় এসেছে। এ ঘাঁটি এখন কার নিয়ন্ত্রণে থাকবে? ইতিমধ্যে দেশটিতে তালেবান হামলা জোরদার হয়েছে। দেশটির বেশ কিছু অঞ্চলও দখলে নিয়েছে।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাইডেন প্রশাসন আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা অপসারণের সিদ্ধান্তের ফলে তাদের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সম্পদ হাতছাড়া হচ্ছে। এই সম্পদ হচ্ছে বাগরাম ঘাঁটি। দীর্ঘদিন ধরেই এই ঘাঁটি থেকে মার্কিন ও আফগান সেনারা কৌশলগত বিমান হামলা চালিয়ে আসছিলেন।

বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, বিশাল এই বাগরাম ঘাঁটির অবস্থান কাবুলের ৪০ মাইল উত্তরে। এর নামকরণ কাছের একটি গ্রামের নামে। এটি ৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে অবস্থিত। বাগরাম বিমানঘাঁটিটি গড়ে তুলেছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, যখন তারা ৮০–এর দশকে আফগানিস্তান দখল করে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন বাহিনী সেখানে যায় ২০০১ সালের ডিসেম্বরে এবং এই ঘাঁটির পরিসর তারা ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে তোলে। সেখানে এখন ১০ হাজার সৈন্য থাকতে পারেন। বাগরামে বিমান ওঠানামার জন্য দুটি রানওয়ে আছে, এর মধ্যে নতুন রানওয়েটি এর ১২ হাজার ফুট রানওয়েতে যেকোনো আকারের মার্কিন সামরিক যুদ্ধবিমান ওঠানামা করতে পারে। ২০০৬ সালে ৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার খরচে এটি তৈরি করা হয়। বিমান পার্ক করার জন্য সেখানে ১১০টি জায়গা আছে। এগুলো বিস্ফোরণপ্রতিরোধী দেয়াল দিয়ে সুরক্ষিত।


নিরাপত্তা থিঙ্কট্যাংক গ্লোবাল সিকিউরিটির তথ্য অনুযায়ী, বাগরামে তিনটি বড় হ্যাঙার, একটি কন্ট্রোল টাওয়ার ও অসংখ্য প্রয়োজনীয় ভবন তৈরি করা হয়েছে। এলাকার মধ্যে রয়েছে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল, জরুরি সেবার জন্য নির্দিষ্ট এলাকা, অস্ত্রোপচারের জন্য তিনটি অপারেটিং থিয়েটার এবং আধুনিক সরঞ্জামবিশিষ্ট দন্ত চিকিৎসার ক্লিনিক।

বাগরাম বিমানঘাঁটির নিরাপত্তায় কড়া পাহারা বসানো হয়েছিল
ছবি : রয়টার্স

সেখানে আছে বন্দীদের জন্য কুখ্যাত এক কারাগার। এ কারাগার পরিচিত হয়ে উঠেছিল আফগানিস্তানের গুয়ানতানামো নামে।

স্নায়ুযুদ্ধের সময় তৈরি ঘাঁটিটিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনারা প্রায় ১০ বছর ছিলেন। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারের পর এখানে তালেবান ও নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের যোদ্ধারা দখল নিতে লড়াই শুরু করেন। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সেনারা যখন এটি দখল করেন, তখন এর অবস্থা ছিল ধ্বংসপ্রায়। তাঁরা এখানে স্থায়ী ব্যারাক তৈরি করেন। একসময় এখানে সেনা ও বেসামরিক লোকজন একত্রে থাকতে শুরু করেন।

বাগরামের চিত্র

একসময় যখন আফগানিস্তানে এক লাখের বেশি মার্কিন সৈন্য ছিল তখন বাগরামের অর্থনীতির ৮০ শতাংশ নির্ভরশীল ছিল বিদেশি সেনাদের ওপরেই। একসময় তিন হাজারের বেশি স্থানীয় কর্মী প্রতিদিন ওই ঘাঁটিতে কাজ করতে যেতেন। ঘাঁটির মূল দরজায় সকালে হাজার মানুষের সারি দেখা যেত।

কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে আফগানিস্তানে যুদ্ধ কার্যক্রম শেষে মার্কিন সেনারা ঘাঁটি ছাড়তে শুরু করলে বাগরাম একটি দ্বীপের মতো হয়ে দাঁড়ায়। এই ঘাঁটির নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। ঘাঁটির আশপাশের এলাকায় হামলা বাড়তে শুরু করলে শহরের জনসংখ্যা কমে যায়। স্থানীয় কর্মীদের বদলে বিদেশি কন্ট্রাক্টরা সেখানে কাজ শুরু করেন। ফলে মূল ঘাঁটি ও এর চারপাশের মানুষজনের মধ্যে একটি দেয়াল তৈরি হয়ে যায়। ২০১৬ সালের নভেম্বরে বাগরাম ঘাঁটিতে আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনা ঘটে।

এতে চারজন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হন। তবে গত শুক্রবার বাগরামের জেলা প্রশাসক দারওয়াইশ রাউফি বলেন, রাতারাতি মার্কিন সেনাদের ঘাঁটি ত্যাগের বিষয়টিতে স্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে কোনো সমন্বয় ছিল না। আফগান সেনারা ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার আগেই স্থানীয় অনেকেই সেখানে লুটপাট চালায়।

সহযোগিতার আশ্বাস

গত শুক্রবার অনেকটাই নীরবে বাগরাম বিমানঘাঁটি ছেড়ে যান মার্কিন সেনারা। এটি ছিল আফগানিস্তানে তাঁদের যুদ্ধের মূল কেন্দ্র। গত শুক্রবার দুই মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, এই বিমানঘাঁটি ইতিমধ্যে আফগানিস্তান জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনী ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাছে পুরোপুরি হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে সেখানে থাকা সেনাদের সুরক্ষিত করার জন্য এখনো সব ক্ষমতা এবং কর্তৃপক্ষ বজায় রেখেছেন আফগানিস্তানে শীর্ষ মার্কিন কমান্ডার জেনারেল অস্টিন এস মিলার। শুক্রবার তিনি আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির সঙ্গে দেখা করেন এবং মার্কিন সহযোগিতা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দেন।

নির্দিষ্ট করে না বলা হলেও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য বার্ষিক ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার করে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘটনাটিকে স্বাগত জানিয়েছে তালেবান। একে ইতিবাচক পদক্ষেপ বলেছে। তারা দেশটির সব এলাকা থেকে বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে।

ভবিষ্যৎ কোন পথে

বিবিসি বলছে, বাগরাম ছেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সৈন্য সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শিগগিরই সম্পন্ন হচ্ছে। কিন্তু কাবুলের উত্তরে বিস্তীর্ণ এই ঘাঁটি থেকে বিদেশি সেনা প্রত্যাহার করা হচ্ছে যখন আফগানিস্তানের জিহাদি গোষ্ঠী তালেবান দেশটির বহু এলাকায় তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। আমেরিকা এখন আফগান সরকারের হাতে দেশটির নিরাপত্তার দায়িত্ব তুলে দিতে চাইছে। বিদেশি সেনাদের চলে যাওয়ার খবরে আশান্বিত তালেবান আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বিদেশি বাহিনী পুরোপুরি দেশ ত্যাগ করার পর নতুন করে আবার গৃহযুদ্ধ বাধার আশঙ্কা রয়েছে।

তবে এই বিমানঘাঁটিকে ঘিরে যে জনপদ ও জীবিকা গড়ে উঠেছে, যার ওপর বহু সাধারণ মানুষের রুটি–রুজি নির্ভর করছে, তারা এখন তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।

সামরিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, কাবুলকে সুরক্ষিত রাখতে এবং তালেবানকে দূরে রাখতে আফগান সরকার কতটা সফল হয়, তা নির্ভর করবে দেশটির সরকার বাগরামের নিয়ন্ত্রণ কতটা বজায় রাখতে সক্ষম হয় তার ওপর।