ইরান ও ইসরায়েলের ছায়াযুদ্ধ বিপজ্জনক মোড়ে

ইরানের নাতাঞ্জ পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছে তেহরান
ছবি: এএফপি

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার অঘোষিত ছায়াযুদ্ধ দীর্ঘদিনের। এই ছায়াযুদ্ধ এখন একটি বিপজ্জনক মোড় নিয়েছে। বিবিসি অনলাইনের এক বিশ্লেষণে এমনটাই বলা হয়েছে।

গত সপ্তাহান্তে ইরানের নাতাঞ্জ পারমাণবিক কেন্দ্রে একটি রহস্যজনক বিস্ফোরণ ঘটে। একে নাশকতা বলে অভিহিত করেছে ইরান। এ হামলার জন্য তারা ইসরায়েলকে দায়ী করেছে।

ঘটনাটির পেছনে ইসরায়েলের হাত আছে কি না, তা তারা প্রকাশ্যে বলেনি। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলি গণমাধ্যমে বিভিন্ন কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হচ্ছে যে এ কাজ ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ করেছে। ইরান তার জুতসই সময়ে এ হামলার প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছে।

এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে ক্রমেই বাড়তে থাকা শত্রুতা, পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থার ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ এ ঘটনা ঘটল।

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধ বাধলে, তা উভয়ের জন্যই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও ধ্বংসাত্মক হবে। এ পরিস্থিতি এড়াতে তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে গোপন বা ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে আসছে। এই ছায়াযুদ্ধের ঝুঁকি ও এর পরিণতি বিবিসির নিরাপত্তাবিষয়ক সংবাদদাতা ফ্র্যাংক গার্ডনার তাঁর বিশ্লেষণে তুলে ধরেছেন। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার ছায়াযুদ্ধকে তিনটি স্বতন্ত্র ক্ষেত্রে ভাগ করা যায় বলে বিশ্লেষণে উল্লেখ করা হয়। এগুলো হলো ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি, সমুদ্রপথে নৌ চলাচল, সিরিয়া ও লেবানন।

ইরান বারবার বলে আসছে যে তার পরমাণু প্রকল্প পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে। তবে ইরানের এ কথা বিশ্বাস করে না ইসরায়েল। ইসরায়েল মনে করে, ইরান গোপনে পরমাণু অস্ত্র ও ব্যালিস্টিক মিসাইল তৈরির লক্ষ্যে কাজ করে চলছে।

এমন চিন্তা থেকে ইসরায়েল তার প্রতিপক্ষ ইরানের পরমাণু প্রকল্প বাধাগ্রস্ত বা অচল করে দিতে দীর্ঘদিন ধরে একের পর এক গোপন তৎপরতা চালিয়ে আসছে। এ তৎপরতা এখন একটি সম্ভাব্য বিপজ্জনক পর্যায়ে রয়েছে।

২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে ছয় বিশ্বশক্তির ঐতিহাসিক পারমাণবিক চুক্তি হয়েছিল। ২০১৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেন। তিনি ইরানের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রকে সেই চুক্তিতে ফেরাতে চান। অচলাবস্থা ভাঙতে নানা চেষ্টা চলছে। তবে পারমাণবিক চুক্তিটিকে পুনর্বহালের উপযুক্ত মনে করে না ইসরায়েল। তাই এ চুক্তি নিয়ে সমঝোতা নস্যাৎ করতে ইসরায়েল পরিকল্পিতভাবে নানা তৎপরতা চালাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

সাম্প্রতিক সময়ে সমুদ্রপথে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে। চলতি বছরের শুরুর দিকে ইসরায়েলের একটি কার্গো জাহাজ ওমান উপসাগর দিয়ে যাওয়ার সময় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জাহাজের মূল অংশে দুটি বড় গর্ত তৈরি হয়। এ জন্য ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডকে দায়ী করে ইসরায়েল। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে ইরান।

আবার এপ্রিলে লোহিত সাগরে ইরানের একটি জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ জাহাজে ইয়েমেনের ইরানপন্থী হুতি বিদ্রোহীদের জন্য নানান সরঞ্জাম ছিল বলে ইসরায়েল ও সৌদি আরবের ধারণা। জাহাজে হামলার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে ইরান।

যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৮ মাসে ইরানের তেল ও সামরিক সরঞ্জামবাহী সিরিয়ামুখী অন্তত ১২টি জাহাজ ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়।

সিরিয়ায় ১০ বছর ধরে যুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সমর্থনে লেবাননের শিয়াপন্থী মিলিশিয়া সংগঠন হিজবুল্লাহর সঙ্গে এক হয়ে কাজ করছে ইরানের সেনাবাহিনী। কখনো কখনো ইসরায়েল অধিকৃত গোলান মালভূমিতে ইরানের সেনাদের হামলার ঘটনাও ঘটেছে। সিরিয়ায় ইরানের এ তৎপরতায় ইসরায়েল বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। এ উদ্বেগ থেকে সিরিয়ায় ইরানের ঘাঁটি ও সরবরাহপথের ওপর ইসরায়েল অনেকবার বিমান হামলা চালিয়েছে।

ইরান ও ইসরায়েল কেউই নিজেকে দুর্বল অবস্থায় দেখতে চায় না। ছায়াযুদ্ধের পরিণতিতে তারা যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যেতে পারে। তবে ইরান ও ইসরায়েল উভয়ই জানে, তাদের এমনভাবে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, যাতে সর্বাত্মক যুদ্ধ না বাধে।