করোনার ডেলটা ভেরিয়েন্ট সম্পর্কে যা জানা গেল

করোনাভাইরাস
প্রতীকী ছবি

ভারতে করোনাভাইরাসের নতুন একটি ধরন (ভেরিয়েন্ট) শনাক্ত হয় গত ফেব্রুয়ারিতে। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে বেশ কয়েকটি দেশে। এই ভেরিয়েন্টটি হঠাৎ করে সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণ হওয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এই সংক্রমণ ঠেকাতে অনেক দেশই নতুন করে লকডাউনের মতো সিদ্ধান্ত নেয়। অনেকেই লকডাউনের মতো সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের পথ থেকে পিছু হটে। এখন করোনাভাইরাসের যেসব টিকা বাজারে এসেছে তা কতটুকু কার্যকর, এ নিয়েও প্রশ্ন ওঠে নতুন এই ভেরিয়েন্টের বিস্তারে।

ভারতে পাওয়া এই ভেরিয়েন্টের নতুন নাম ডেলটা ভেরিয়েন্ট। বৈজ্ঞানিক নাম বি.১.৬১৭.২। যুক্তরাষ্ট্রের করোনার যেসব নমুনা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে, তার মধ্যে ৬ শতাংশ এই ভেরিয়েন্ট। দেশটির রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা সিডিসি এ তথ্য জানিয়েছে। এই সংখ্যা দেখে মনে হতে পারে, শতকরা হিসাবে তো অনেক কম। কিন্তু এই ভেরিয়েন্ট যে দ্রুত ছড়াচ্ছে তার প্রমাণ সিডিসির তথ্য থেকেই পাওয়া যাচ্ছে। কারণ এক মাস আগে করোনার বিশ্লেষিত নমুনার মধ্যে এই ভেরিয়েন্ট ছিল ১ শতাংশ।

এই ভেরিয়েন্ট যে খুব দ্রুত ছড়ায়, তার প্রমাণ দিচ্ছে ভারতই। গত দুই মাসে দেশটিতে সংক্রমণ ব্যাপক আকার ধারণ করার অন্যতম কারণ এই ভেরিয়েন্ট। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ভেরিয়েন্ট। ব্রিটিশ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকক জানিয়েছেন, দেশটিতে নতুন যেসব সংক্রমণ শনাক্ত হচ্ছে তার ৯১ শতাংশ এই ডেলটা ভেরিয়েন্ট। সম্প্রতি দেশটিতে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার কারণও এই ভেরিয়েন্ট। এই ভেরিয়েন্ট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও।

ডেলটা কি বেশি সংক্রামক?

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, ভারতে শনাক্ত এই ডেলটা ভেরিয়েন্ট অন্য ধরনগুলোর চেয়ে বেশি সংক্রামক কি না। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরাও হতাশার কথা শুনিয়েছেন। তারা বলেছেন, এই ভেরিয়েন্ট অন্যগুলোর চেয়ে বেশি ছড়ায়। হ্যানকক গত সপ্তাহে বলেছেন, আলফা ভেরিয়েন্টের চেয়ে এটি ৪০ শতাংশ বেশি সংক্রামক। আবার আলফা ভেরিয়েন্টটি প্রথম সংস্করণের ভাইরাসটির চেয়ে বেশি সংক্রামক।

এর সংক্রমণ ক্ষমতা বেশি—সেটা যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ফাউসিও নিশ্চিত করেছেন। তিনিও বলেছেন, নতুন যেসব গবেষণা হয়েছে তা থেকে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে, এই ভেরিয়েন্ট বেশি সংক্রামক। ফাউসি বলেছেন, ‘যুক্তরাজ্যে নতুন এই ভেরিয়েন্টের সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে, তা আমরা মার্কিন মুলুকে হতে দিতে পারি না।’

ডেলটা ভেরিয়েন্ট বেশি প্রাণঘাতী?

এই ডেলটা ভেরিয়েন্টটি কতটা প্রাণঘাতী, তা নিয়েও গবেষণা হয়েছে। যুক্তরাজ্যের জনস্বাস্থ্য বিভাগ পিএইচই বলেছে, এই ভেরিয়েন্টে আক্রান্ত ব্যক্তিদের হাসপাতালে নেওয়ার ঝুঁকি বেশি। তারা তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বলেছে, এটি আলফা ভেরিয়েন্টের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। পিএইচই এ নিয়ে সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছে। তারা বলেছে, এই ভেরিয়েন্টে আক্রান্ত ব্যক্তিরা বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। ফলে হাসপাতালে নেওয়ার ঝুঁকিও বাড়ছে। এ জন্য যুক্তরাজ্যেই ৩৮ হাজারের বেশি নমুনা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, যুক্তরাজ্যে শনাক্ত আলফা ভেরিয়েন্টের চেয়ে এটি ২ দশমিক ৬১ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সংক্রমিত হওয়া থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

ফাউসিও যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন এই বিষয়ে। তিনিও বলেছেন, এই ভেরিয়েন্টের কারণে মৃত্যু বাড়তে পারে।

অক্সফোর্ডের তৈরি টিকা
প্রতীকী ছবি: এএফপি

টিকায় সুরক্ষা মিলবে?

তবে স্বস্তির খবর হলো, ডেলটা ভেরিয়েন্টের বিরুদ্ধে টিকা কার্যকর। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের মেডিকেল ব্রাঞ্চ ও বায়োএনটেকের গবেষকেরা গতকাল বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন, ফাইজার ও বায়োএনটেকের টিকা ডেলটাসহ অন্যান্য ভেরিয়েন্টের বিরুদ্ধে কাজ করে। টিকা নেওয়া ব্যক্তিদের রক্ত পরীক্ষা করে এ তথ্য জানা গেছে। যুক্তরাজ্যও একই খবর দিয়েছে। দুই ডোজ টিকা নিলে পূর্ণাঙ্গ সুরক্ষা পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এক ডোজ নিলেও সুরক্ষা মিলবে, তবে থাকবে ঝুঁকি।

পিএইচই এর আগেই অবশ্য জানিয়েছে, ডেলটা ভেরিয়েন্টের বিরুদ্ধে অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও মডার্নার টিকাও কার্যকর। এই দুই টিকার দুটি করে ডোজ নিলে সুরক্ষা পাওয়া যাবে।

কত দেশে ছড়িয়েছে এই ভেরিয়েন্ট?

ডেলটা ভেরিয়েন্ট এক দেশের ভেতরে যেমন দ্রুত ছড়াচ্ছে, তেমনি এক দেশ থেকে আরেক দেশেও ছড়াচ্ছে দ্রুত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, এ পর্যন্ত ৭৪টি দেশে ছড়িয়েছে এই ভেরিয়েন্ট। অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া সব মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে এই ভেরিয়েন্ট। গত মঙ্গলবার রোগতত্ত্ববিষয়ক যে আপডেট সংস্থাটি দেয়, তা থেকে এই তথ্য জানা গেছে।

করোনাভাইরাসের ডেলটা ভেরিয়েন্টের কারণে বিভিন্ন দেশে করোনার নতুন ঢেউ আসতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। যেমন ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের রোগতত্ত্ববিদ নেইল ফার্গুসন মনে করেন, যুক্তরাজ্যে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের কারণ হতে পারে এই ভেরিয়েন্ট।