কিমের সবুজ ট্রেনে কী ছিল?

উত্তর কোরিয়া থেকে একটি সবুজ ট্রেন গেছে চীনে। আর এ নিয়ে শুরু হয়েছে শোরগোল। ট্রেন আসাকে কেন্দ্র করে বেইজিংয়ের রাস্তায় নিরাপত্তার ঘেরাটোপ দেখে ‘জল্পনা’ ছড়িয়ে পড়েছে, কিম জং-উন ছিলেন ট্রেনে। দুই দেশের কর্তৃপক্ষের ঢাক ঢাক গুড় গুড় মনোভাবে সেই জল্পনা এখন বাস্তবে রূপ নিয়েছে।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, গতকাল সোমবার রাতে বেইজিংয়ের কেন্দ্রীয় রেলস্টেশনে পৌঁছায় সবুজ রঙের ট্রেনটি। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, চীন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করতে এসেছেন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন। পুরো ট্রেনে ছিল মোট ২১টি বগি। প্রতিটি বগির রং গাঢ় সবুজ।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে এখন আলোচনা চলছে কিমের ট্রেনে কী ছিল, তা নিয়ে। উত্তর কোরিয়ার সর্বেসর্বা নেতার ‘রহস্যজনক’ সফর নিয়ে খুব বেশি তথ্য জানা যায়নি। দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ের কোনো সরকারি কর্মকর্তাই স্বনামে কিমের সফরের কথা স্বীকার করেননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কিছু সূত্র এ খবর নিশ্চিত করেছে।

একটি বিশ্বস্ত সূত্রের বরাত দিয়ে সিএনএন জানিয়েছে, ওই ট্রেনে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিমের থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তবে ২০১১ সালের পর এটিই হবে উত্তর কোরিয়ার বাইরে কিমের প্রথম সফর। এদিকে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনিয়িং বলেছেন, কিম জং-উনের বেইজিং সফরের বিষয়ে তাঁর কোনো ‘ধারণা নেই’। তবে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট ও ব্লুমবার্গের দাবি, তিনজন ব্যক্তি এ সফর সম্পর্কে জানেন। যদিও এখনো মুখ খোলেনি কেউ।
অবশ্য এটিও ধারণা করা হচ্ছে, ওই সবুজ ট্রেনে কিম জং-উনের বদলে থাকতে পারেন তাঁর বোন কিম ইয়ো জং। তবে এখন পর্যন্ত উনের পক্ষেই ভোট বেশি।
মঙ্গলবার বিকেলে ওই সবুজ ট্রেনটিকে বেইজিং ছেড়ে যেতে দেখা গেছে। সিএনএন ও জাপানের কিয়োদো নিউজ এজেন্সি এ খবর নিশ্চিত করেছে। আগমনের মতো প্রস্থানেও নিরাপত্তার কড়াকড়ি ছিল দেখার মতো।
কী আছে ট্রেনে?
দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, কিমের মতোই ট্রেনে বিদেশ সফরে যেতেন তাঁর বাবা ও দাদু। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ট্রেনটিতে কমপক্ষে ৯০টি বগি রয়েছে। এই বগিগুলোতে আছে কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা। ২০০৯ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, মূলত তিনটি ট্রেনের বহর নিয়ে বিদেশে যান কিম। তাঁর বাবাও এভাবেই যাতায়াত করতেন। বহরের প্রথমে থাকে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একটি উন্নতমানের ট্রেন। এরপরই থাকে উত্তর কোরীয় নেতাকে বহনকারী ট্রেন। আর সবার শেষে থাকে অতিরিক্ত নিরাপত্তারক্ষী, দেহরক্ষী ও প্রয়োজনীয় রসদ বহনকারী আরেকটি ট্রেন।

কিমকে বহনকারী ট্রেনের প্রত্যেকটি বগিই বুলেটপ্রুফ। সাধারণ বগির তুলনায় এগুলোর ওজন কয়েক গুণ বেশি। ওজন বেশি থাকায় ট্রেনের গতি অপেক্ষাকৃত কম। ধারণা করা হয়, কিমের সবুজ ট্রেনের গতি ঘণ্টায় মাত্র ৩৭ মাইল।
২০০৯ সালের ওই প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস আরও জানিয়েছে, তিন ট্রেনের প্রথমটিতে থাকেন প্রায় ১০০ নিরাপত্তাকর্মী। এঁরা মূলত বিভিন্ন রেলস্টেশন ও রেললাইনে তল্লাশি ও অনুসন্ধান চালান। প্রয়াত নেতা কিম জং-ইলের সময় থেকেই এই নিয়ম চলে আসছে। এই নিরাপত্তাকর্মীরা বোমা ও অন্যান্য হুমকির মোকাবিলা করেন। এ ছাড়া ট্রেনবহর চলার সময় আকাশে উড়তে থাকে সামরিক হেলিকপ্টার ও উড়োজাহাজ।
ওই প্রতিবেদনে আরও দাবি করা হয়েছিল যে উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতার ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য দেশটির বিভিন্ন এলাকায় তৈরি করা হয়েছে মোট ২০টি বিশেষ রেলস্টেশন।
উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম খুব কম সময়ই কিমের ট্রেনের ভেতরের ফুটেজ ব্যবহার করেছে। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত নানা স্থির ও ভিডিও চিত্রে এই ট্রেনের ভেতরের বিভিন্ন দৃশ্য প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৫ সালে প্রকাশিত এক ভিডিও চিত্রে একটি সম্মেলন কক্ষ দেখানো হয়েছিল। বলা হয়ে থাকে, এই ট্রেনে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রয়েছে। সম্মেলন কক্ষ, ডিনার কক্ষ, ব্যাংকুয়েট হল ছাড়াও আছে অফিস ঘর। ট্রেনে বসেই রাষ্ট্রের সব কাজ করতে পারেন উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা।
বিভিন্ন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে দাবি করা হয়ে থাকে, কিম জং-উনের বাবা কিম জং-ইল উড়োজাহাজে উঠতে ভয় পেতেন। এ কারণেই তিনি ট্রেনে ভ্রমণ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। এসব ট্রেনে উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা আছে। ট্রেনে বসেই যে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারা যায়।
২০১১ সালে কিম জং-ইলের সফরসঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন রুশ কর্মকর্তা কোনস্টানটিন পুলিকোভস্কি। দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে তিনি বলেন, ‘ওই ট্রেনে সব ধরনের খাবার পাওয়া যেত। ইচ্ছে করলেই রাশিয়া, চীন, কোরিয়া, জাপান ও ফ্রান্সের যেকোনো খাবারের ফরমাশ দেওয়া যেত।’ তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন জায়গায় থেমে থেমে ট্রেনে রসদ নেওয়া হতো এবং ট্রেনে প্যারিস থেকে বিশেষ ওয়াইনের সরবরাহ আসত।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে আরও বলা হয়েছে, নেতার একঘেয়েমি কাটাতে ট্রেনে থাকে নারীদের একটি দল। তবে খাবারের ক্ষেত্রে বাবার চেয়ে কিম জং-উনের পছন্দ আলাদা। তিনি নাকি সুইস চিজ ও ক্রিস্টাল শ্যাম্পেন বেশি পছন্দ করেন।

ট্রেনটি কেন চীনে?
সম্প্রতি কোরিয়ান পিপলস আর্মির সুপ্রিম কমান্ডার কিমের বৈঠকের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আগামী মে মাস নাগাদ এ বৈঠক হতে পারে বলে ওয়াশিংটনে অবস্থানরত দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। বৈঠকের সুনির্দিষ্ট তারিখ ও স্থান এখনো ঠিক হয়নি।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, চীনের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার সম্পর্ক বরাবরই ভালো। ধারণা করা হচ্ছে, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আসন্ন শান্তি আলোচনার প্রস্তুতি নিতেই চীনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন কিম।
তবে কিছুদিন ধরে চীনের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার সম্পর্কে একটু টানাপোড়েন চলছিল। গত বছর উত্তর কোরিয়ার চালানো কয়েক দফা ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার কারণেই চীন একটু বিরক্ত হয়েছিল। কারণ, এর ফলে নতুন করে নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছিল দেশটি। আর চীন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা প্রশমন করতে চাইছিল।
চীনের সঙ্গে উত্তর কোরিয়া প্রতিরক্ষা চুক্তি রয়েছে। এই চুক্তির আওতায় যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি বা বৈদেশিক আক্রমণের ক্ষেত্রে পরস্পরকে সহায়তা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ দুটি দেশ। দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারের একটি সূত্র বলেছে, এ ধরনের সফরে বোঝা গেছে যে বেইজিং ও পিয়ংইয়ংয়ের মধ্যকার সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে।
বেইজিংয়ের কারনেগি সিংহুয়া সেন্টারের উত্তর কোরিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ তং ঝাও সিএনএনকে বলেন, চীনের সমর্থন নিশ্চিত করতেই আকস্মিক এ সফর। আসন্ন শীর্ষ সম্মেলনের আগে প্রস্তুতি নিতেই এ পদক্ষেপ। এ ধরনের সম্মেলন একদিকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, অন্যদিকে খুব ঝুঁকিপূর্ণও। কোনো কারণে এ সম্মেলন ব্যর্থ হলেই যুক্তরাষ্ট্র একে কূটনৈতিক ব্যর্থতা বলে অভিহিত করবে। তাই এ ক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়ার ‘ইনস্যুরেন্স পলিসি’ দরকার। ধারণা করা হচ্ছে, সে জন্যই এ ট্রেন সফর।