কোভিড বদলে দিচ্ছে এশীয় অভিবাসীদের জীবন

চীনের নাগরিকদের ওপর হামলাবন্ধে প্রচার চালাচ্ছে চায়না টাউন ব্লক ওয়াচের স্বেচ্ছাসেবীরা। চায়না টাউন, নিউইয়র্ক সিটি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
ফাইল ছবি: রয়টার্স

করোনাভাইরাসের মহামারি শুরুর পর বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, করোনা-পরবর্তী সময়ে বদলে যাবে জীবনাচার। কিন্তু এই মহামারি শেষ হওয়ার আগেই এশীয় অভিবাসীদের জীবন বদলে যেতে শুরু করেছে। বিভিন্ন দেশে তাঁরা রোষানলে পড়ছেন। বাড়ছে বর্ণবাদ এবং এর শিকার হচ্ছেন এশীয়রা।

এর কিছু খণ্ডচিত্র তুলে ধরা যেতে পারে। থাইল্যান্ডের এক নাগরিককে হত্যার করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। এমন ঘটনা ঘটেছে ফিলিপাইনের নাগরিকের সঙ্গেও। চীনের এক নারীর গায়ে আগুন দেওয়া হয়েছে। একটি এশীয় স্পা সেন্টারে গুলি চালিয়ে আটজনকে হত্যা করা হয়েছে দেশটিতে।

শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই এমন ঘটনা ঘটছে, তা কিন্তু নয়; ব্রাজিলে সাও পাওলোর একটি জিমে ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করেন সিসি বিয়ানকা ঐশী দে লিমা। জিমে আসা এক ব্যক্তি লিমাকে বলেছিলেন, তিনি যদি চীনের নাগরিক হন, তবে তাঁর কাছ থেকে সেবা গ্রহণ করবেন না। লিমা বলেছেন, ‘লোকটা এমনভাবে তাকাচ্ছিলেন যেন আমিই ভাইরাস।’

যুক্তরাজ্যের লন্ডনে মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করেন ইয়ান ওং। করোনার মহামারি শুরুর পর তাঁর কাছ থেকে মেকআপ নিতে অস্বীকৃতি জানান এক ব্যক্তি। ওংকে ওই ব্যক্তি বলেছিলেন, ‘মহামারি শুরু হয়েছে। আপনার কাছ থেকে আমি মেকআপ নিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি না।’

কুয়েতের সালওয়ায় স্কুলশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন মণিকা। মহামারি শুরুর পর তাঁর সহকর্মীরা তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করেছেন। ইতালিতে এমন ঘটনাও ঘটেছে যে এশীয়দের দোকানে গ্রাহক আসতে চাইত না। এশীয় হওয়ায় অস্ট্রেলিয়ায় হত্যার হুমকিও পেয়েছেন কেউ কেউ।

আবার শুধু এশিয়ার বাইরে যে এমন ঘটনা ঘটছে, তা নয়; খোদ এশিয়াতেও ঘটছে এমন ঘটনা। দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলের পার্শ্ববর্তী চায়না টাউনের অনেক রেস্তোরাঁয় দেশটির নাগরিকেরা যাচ্ছেন না। কারণ, সেখানে চীনের নাগরিকেরা বেশি যান। জাপান ও ইন্দোনেশিয়াতে চীনের নাগরিকেরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

করোনার কারণে কাজ বন্ধ। লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণের খাবার সংগ্রহ করছেন চীনের নাগরিকেরা। চায়না টাউন, নিউইয়র্ক সিটি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারেও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন অনেকে। এসব দেশে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন মূলত মুসলিমরা। এসব ঠেকাতে দেশগুলোর নেতারা তেমন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। মহামারির দোহাই দিয়ে মিয়ানমারের নেতারা তো একে বৈধতা দেওয়ারও চেষ্টা করে চলেছেন।

বৈষম্য নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় একটি জরিপ চালানো হয়েছে গত বছরের অক্টোবরে। অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এ জরিপ চালায়। জরিপ অনুসারে ৬৬ শতাংশের বেশি এশীয়-অস্ট্রেলীয় কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। আগের তুলনায় ছয় মাসে এই বৈষম্য বেড়েছে ১৫ শতাংশ। ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা বলেছেন, গত বসন্তে এশীয়রা তুলনামূলক কম সময় কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআই প্রতিবছর বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধের চিত্র তুলে ধরে। ২০১৯ সালে এমন অপরাধের নথিবদ্ধ হয়েছিল ২০০-এর বেশি। এরপর ২০২০ ও ২০২১ সালে এই অপরাধের চিত্র এখনো প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যেভাবে এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তাতে এটা সহজেই অনুমেয় যে এমন বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধ বেড়ে চলেছে। এ ছাড়া বিশ্লেষকেরা বিভিন্ন সময়ই বলেছেন, মহামারি শুরুর পর এই অপরাধ কয়েক গুণ বেড়েছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য একটি আইনে স্বাক্ষরও করেছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন।

মহামারি শুরুর পর সম্পর্কের অবনতি হয়েছে চীন ও অস্ট্রেলিয়ার
ফাইল ছবি: রয়টার্স

করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে বিদ্বেষপ্রসূত অপরাধের শিকার—এমন তথ্য নিয়ে কাজ করা মার্কিন ওয়েবসাইট স্টপ এএপিআই হেটের দেওয়া তথ্য অনুসারে, মহামারির শুরুর পর গত বছরের ১৯ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত শুধু যুক্তরাষ্ট্রে হয়রানি, বৈষম্য ও আক্রমণের শিকার হয়েছেন—এমন ঘটনা ঘটেছে প্রায় তিন হাজার। দেশটিতে হয়রানির শিকার ব্যক্তিরা নিজেরাই এমন ঘটনা ওই ওয়েবসাইটে লিপিবদ্ধ করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায় চীনের নাগরিকেরা যেমন কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, তেমনি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন যুক্তরাজ্যেও। খোদ ব্রিটিশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এ তথ্য প্রকাশ করেছে। সরকারি হিসাব অনুসারে, যুক্তরাজ্যে অন্য যেকোনো দেশের নাগরিকের তুলনায় চীনের নাগরিকেরা চাকরি হারিয়েছেন বেশি।

ইউরোপের দেশ ইতালি, গ্রিস, ফ্রান্স ও জার্মানিতেও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন এশীয়রা। আফ্রিকার দেশ কেনিয়া, ইথিওপিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকাতেও এমন ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনা ঘটাচ্ছেন অভিবাসনবিরোধী, শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী, উগ্র জাতীয়তাবাদী ও ইহুদিবিরোধীরা। শরণার্থী ও প্রবাসী শ্রমিকেরা যেমন হামলার শিকার হচ্ছেন, তেমনি বিশ্বজোড়া পরিচিত মুখ, এমনকি এশীয় বংশোদ্ভূত রাজনীতিকেরাও এমন হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

এশীয়রা যে বৈষম্য, হয়রানি, নির্যাতন, হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, তার বৈধতাও দেওয়া হচ্ছে। কারণ, করোনা মহামারির শুরুর পরই এর বিস্তারের জন্য চীনকে দায়ী করেছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ ভাইরাসকে কখনো ‘উহান ভাইরাস’, কখনো ‘চায়না ভাইরাস’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন তিনি। সংবাদ সম্মেলনে এসব মন্তব্য করে হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়েছিলেন তিনি। এর সদুত্তর দিতে না পেরে সংবাদ সম্মেলন থেকে বেরিয়েও গেছেন। কিন্তু দমে যাননি। চীনের বিরুদ্ধে তদন্ত চেয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে সুর মিলিয়েছিলেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো। সঙ্গে ছিল অস্ট্রেলিয়াও। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এসবের কারণে উগ্রপন্থীরা আশকারা পেয়েছে, হামলার পরিমাণ বেড়েছে।

এই মহামারিতে মানসিকভাবে সবাই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত। দ্য ল্যানসেট সাইকিয়াট্রি সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, মহামারির বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মানুষের মনের ওপর। এটি ক্ষতিগ্রস্ত করছে সামাজিক সম্পর্ককে। এশীয়রা এই মহামারির বাইরে নয়। এ কারণে তাঁদের ওপরও এই প্রভাব পড়ছে। সঙ্গে অভিবাসীরা বাড়তি আতঙ্কে থাকছেন নির্যাতন, বৈষম্য ও হত্যার হুমকি নিয়ে।

মহামারি থেকে পৃথিবী মুক্তি পেলে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার কথা। যদিও বিজ্ঞান বলছে ভিন্ন কথা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মহামারির প্রভাব থেকে যাবে বছরের পর বছর। অর্থাৎ এশীয় অভিবাসীদের মহামারির প্রত্যক্ষ প্রভাবে ভুগতে হতে পারে। সেই সঙ্গে মহামারির ক্ষত কাটিয়ে না ওঠা পর্যন্ত হয়তো এমন হুমকি, বৈষম্য ও নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে পারে আরও কয়েক বছর।

তথ্যসূত্র: রয়টার্স, এএনআই, বিবিসি, ইউএসটুডে, সিএনএন ও হিন্দুস্তান টাইমস