গণতন্ত্রের বিজয়ের এক গল্প

পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ। কোথাও গণতন্ত্রের সময় ভালো যাচ্ছে না। দিকে দিকে শুধু মার খাওয়ার গল্প। অবস্থা এতই বেগতিক যে কেউ কেউ গণতন্ত্রের মৃত্যুঘণ্টাও শুনে ফেলেছেন।

দাঁড়ান, দাঁড়ান। হতাশ হয়ে এখনই গণতন্ত্রের কফিনে পেরেক মারার আয়োজন সারবেন না। আশা এখনো আছে।

গণতন্ত্রের এই দুঃসময়ে একটা ভালো খবর আছে। খবরটা এসেছে মোহাম্মদ বুয়াজিজির দেশ থেকে। এত দিনে হয়তো অনেকেই মোহাম্মদ বুয়াজিজিকে দিব্যি ভুলে গেছেন। ভুলে যাওয়ারই কথা। বিশ্বজুড়ে নানা ঘটন-অঘটনের মধ্যে কার কথা কে মনে রাখে!

মোহাম্মদ বুয়াজিজির দেশ তিউনিসিয়া। ২৬ বছর বয়সী এই আরব তরুণ ছিলেন রাস্তার ফেরিওয়ালা। বেকারত্ব, হয়রানি, নির্যাতনের প্রতিবাদে ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর প্রকাশ্যে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন বুয়াজিজি। ২০১১ সালের ৪ জানুয়ারি তিনি মারা যান।

ক্ষোভে-প্রতিবাদে বুয়াজিজি নিজের গায়ে যে আগুন দিয়েছিলেন, তা পুরো তিউনিসিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না। তুমুল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিউনিসিয়ায় স্বৈরশাসক জয়নুল আবদিন বেন আলীর পতন হয়। সূচিত হয় আরব বসন্ত। তিউনিসিয়ার আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে অগণতান্ত্রিক আরব বিশ্বে। বিপ্লবের ঢেউয়ের তোড়ে মসনদ গুঁড়িয়ে যায় মিসরের হোসনি মোবারক, ইয়েমেনের আলী আবদুল্লাহ সালেহ, লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফির। আন্দোলন-বিক্ষোভের মুখে কয়েকটি আরব দেশ সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেয়। কোনো কোনো দেশ আন্দোলন দমন করে। আর আরব বসন্তের হাওয়া ঘুরিয়ে দিয়ে সিরিয়া, লিবিয়া ও ইয়েমেনে এখন বহুমুখী লড়াই চলছে।

আরব বসন্ত হানা দেওয়া দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র তিউনিসিয়াই ব্যতিক্রম। ছবি: এএফপি
আরব বসন্ত হানা দেওয়া দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র তিউনিসিয়াই ব্যতিক্রম। ছবি: এএফপি

যে চেতনায় আরব বসন্ত এসেছিল, পরের দিকে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম তিউনিসিয়া। নানা প্রতিকূলতা-সীমাবদ্ধতার মধ্যেও দেশটি গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে অব্যাহতভাবে চেষ্টা করে। ফলে আরব বসন্ত হানা দেওয়া দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র তিউনিসিয়াই গণতান্ত্রিক সরকার পায়। তিউনিসিয়ার সদ্য সমাপ্ত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সারা বিশ্বের গণতন্ত্রপন্থীদের মনে আশার আলো জ্বেলেছে। কারণ, এই নির্বাচনে জনগণ তথা গণতন্ত্র জয়ী হয়েছে।

আরব বসন্তের পর গত মধ্য সেপ্টেম্বরে তিউনিসিয়ায় দ্বিতীয়বারের মতো অবাধ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। নির্বাচনে ২৬ জন প্রার্থী অংশ নেন। কিন্তু কোনো প্রার্থীই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ব্যর্থ হন। ফলে শীর্ষ দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর মধ্যে দ্বিতীয় দফার ভোটের নিয়মটি সামনে আসে।

মোহাম্মদ বুয়াজিজি ২০১০ সালের ডিসেম্বরে নিজের গায়ে আগুন দেন। পরে তাঁর মৃত্যু হয়। ছবি: এএফপি
মোহাম্মদ বুয়াজিজি ২০১০ সালের ডিসেম্বরে নিজের গায়ে আগুন দেন। পরে তাঁর মৃত্যু হয়। ছবি: এএফপি

প্রথম দফার নির্বাচনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, তিউনিসিয়ার জনগণ দেশটির রাজনীতির পরিচিত মুখদের চরমভাবে প্রত্যাখ্যান করে। আর যে দুই প্রার্থী শীর্ষে উঠে আসেন, তাঁরা তিউনিসিয়ার রাজনীতিতে ‘আউটসাইডার’। তাঁদের একজন কায়েস সাইদ (৬১)। অন্যজন নাবিল কারুই (৫৬)। এই দুজনের মধ্যে কায়েস রাজনীতিতে একেবারেই নবিশ।

কায়েস তিউনিসিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ছিলেন। ২০১৮ সালে অবসরে যাওয়ার পর রাজনীতিতে নাম লেখান তিনি। কায়েস সামাজিক রক্ষণশীল। তবে তিনি গণতান্ত্রিক সংস্কারের পক্ষে। তিনি নাটুকে নন। কথা বলেন সোজাসাপ্টা। সৎ ব্যক্তি হিসেবে তাঁর ভাবমূর্তি আছে। তিনি জনবান্ধব। তাঁর কোনো রাজনৈতিক দল নেই। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়েছেন তিনি।

নাবিল ব্যবসায়ী। মিডিয়া মোগল। তিনি ক্যারিশম্যাটিক। কড়া পপুলিস্ট। তাঁর আদর্শ ডোনাল্ড ট্রাম্প, রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, রদ্রিগো দুতার্তের মতো নেতারা।

গত মধ্য অক্টোবরে তিউনিসিয়ায় দ্বিতীয় দফার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। কায়েস প্রায় ৭৩ শতাংশ ভোট পেয়ে ভূমিধস জয় পান। নাবিলের প্রাপ্ত ভোট প্রায় ২৭ শতাংশ।

বুয়াজিজির মৃত্যুর জেরে তিউনিসিয়ায় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ছবি: রয়টার্স
বুয়াজিজির মৃত্যুর জেরে তিউনিসিয়ায় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ছবি: রয়টার্স

কায়েসের বিজয়ের খবর শুনে হাজারো লোক রাজধানী তিউনিসের রাজপথে নেমে আসেন। তাঁরা নেচে-গেয়ে উৎসব করেন। স্লোগানে স্লোগানে গণতন্ত্রের বিজয়গাথা প্রচার করেন। তিউনিসের রাস্তায় আরব বসন্তের সূচনালগ্নের আবহ তৈরি হয়। বিজয় উৎসবে শামিল হওয়া বউসাইরি আবিদি নামের একজনের মন্তব্য ছিল, ‘তিউনিসিয়া বিপ্লবের ফল পেতে শুরু করেছে। কায়েস দুর্নীতির লাগাম টানবেন। তিনি হবেন ন্যায়নিষ্ঠ প্রেসিডেন্ট।’

নির্বাচনে নাবিল তাঁর পরাজয় স্বীকার করে নেন। বিবৃতি দিয়ে কায়েসকে অভিনন্দন জানান।

কায়েস তাঁর বিপুল বিজয়কে তিউনিসিয়ার ‘নতুন বিপ্লব’ হিসেবে অভিহিত করেন। এই বিপ্লবের জন্য তিনি দেশটির বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের ধন্যবাদ জানান। কারণ, তরুণ ভোটারদের অধিকাংশ ভোটই তাঁর ঝুলিতে গেছে। একটি সংস্থা জানায়, ১৮-২৫ বছর বয়সী ভোটারদের ৯০ শতাংশ ভোটই কায়েস পেয়েছেন।

তীব্র আন্দোলনে তিউনিসিয়ায় স্বৈরশাসক জয়নুল আবদিন বেন আলীর পতন হয়। ছবি: রয়টার্স
তীব্র আন্দোলনে তিউনিসিয়ায় স্বৈরশাসক জয়নুল আবদিন বেন আলীর পতন হয়। ছবি: রয়টার্স

বিশ্বজুড়ে জনতুষ্টিবাদের দামামা। জনতুষ্টিবাদের জোয়ারের মধ্যে তিউনিসিয়ায় গণতন্ত্রের বিজয়ের গল্প বাকি বিশ্বের জন্য অনুপ্রেরণার।

অন্য সব পপুলিস্ট নেতার মডেলেই নাবিল নির্বাচনী প্রচার চালান। তিনি নিজেকে ট্রাম্পের সঙ্গে তুলনা করেন। প্রচারে প্রচুর অর্থ ঢালেন। প্রতিশ্রুতির খই ফোটান। দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে তিনি উচ্চাভিলাষী সব প্রতিশ্রুতি দেন। ভোটারদের দারিদ্র্যকে পুঁজি করে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করেন। ভোটারদের সহানুভূতি আদায়ে নানা কৌশল খাটান। নিজের মালিকানাধীনসহ অন্য সব মূলধারার গণমাধ্যম থেকে তিনি ব্যাপক সমর্থন পান।

তিউনিসিয়ার সদ্য সমাপ্ত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে শীর্ষ দুই প্রার্থীর একজন ছিলেন নাবিল কারুই। ছবি: এএফপি
তিউনিসিয়ার সদ্য সমাপ্ত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে শীর্ষ দুই প্রার্থীর একজন ছিলেন নাবিল কারুই। ছবি: এএফপি

নাবিলের দল তাঁকে ‘অ্যান্টি-এস্টাব্লিশমেন্ট’ প্রার্থী হিসেবে উপস্থাপন করে। কিন্তু দেশটির বিদ্যমান রাজনীতি ও রাজনৈতিক এলিটদের সঙ্গে তাঁর সখ্য অজানা নয়। দরিদ্র ভোটাররা বুঝতে পারেন, এই ব্যবসায়ী, এই পুঁজিপতি মুখে যা-ই বলুন না কেন, তিনি আসলে তাঁদের লোক নন। তা ছাড়া নাবিলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগ আছে। দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের দিন কয়েক আগেই তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। এই বিষয়টি ভোটারদের মনে দারুণভাবে প্রভাব ফেলে। ভোটাররা নাবিলকে সুযোগবাদী ও রাজনীতিক এলিট হিসেবে গণ্য করেন। দ্বিতীয় দফার ভোটে তাঁর দিক থেকে ভোটাররা মুখ ফিরিয়ে নেন। তিউনিসিয়ায় জনতুষ্টিবাদী কৌশল ব্যর্থ হয়।

কায়েস শিক্ষকসুলভ ভঙ্গিতে নিজের অর্থে নির্বাচনী প্রচার চালান। খরচের ক্ষেত্রে মিতব্যয়িতার নীতি অনুসরণ করেন। কায়েস আগডুম-বাগডুম প্রতিশ্রুতি দেননি। তিনি নতুন করে শুরুর কথা বলেন। রাজনৈতিক ব্যবস্থা বদলের ডাক দেন। অধিকতর প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র চালুর পক্ষে মত দেন। ক্ষমতার বিদ্যমান কাঠামো চ্যালেঞ্জ করেন। পার্লামেন্টারি সিস্টেম বদলে বিকেন্দ্রীকৃত গণতান্ত্রিক মডেলের ধারণা উপস্থাপন করেন। রাজনীতিবিদদের জবাবদিহির পক্ষে জোরালো অবস্থান ব্যক্ত করেন।

মূলধারার গণমাধ্যম কায়েসকে সমর্থন দেয়নি। তবে তিনি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক সমর্থন পান। কায়েসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো অভিযোগ নেই। আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানও বেশ কড়া। তাঁর সততা, স্বচ্ছতা, ন্যায়পরায়ণতা, ক্ষমতার বিদ্যমান কাঠামোবিরোধী মনোভাব, রাজনৈতিক সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা প্রভৃতি বিষয় ভোটারদের মনে দাগ কাটে।

তিউনিসিয়ার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট কায়েস সাইদ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। ছবি: রয়টার্স
তিউনিসিয়ার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট কায়েস সাইদ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। ছবি: রয়টার্স

তিউনিসিয়ার জনগণ ভুল করেননি। তাঁরা জনতুষ্টিবাদের খপ্পরে না পড়ে বরং সঠিক ব্যক্তিকেই তাঁদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নেন। আস্থা রাখেন কায়েসে। এখন তাঁরা নতুন দিনের প্রত্যাশায়।

তিউনিসিয়ায় দ্বিতীয় বিপ্লবের ফল কী হবে, তা এখনই বলা মুশকিল। কারণ, দেশটির সমাজে এখনো অস্থিরতা বিদ্যমান। রাজনীতিতে এলিটদের আধিপত্য। গণতন্ত্র নবীন। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ভঙ্গুর। অর্থনীতি নড়বড়ে। দুর্নীতি সর্বগ্রাসী। বেকারত্ব ব্যাপক। সুশাসন বহুদূর। সন্ত্রাসবাদ মাথাব্যথার কারণ। সব মিলিয়ে কায়েসের সামনে বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ। তবে তিউনিসিয়ার জনগণের বিশ্বাস, প্রথম বিপ্লবে (আরব বসন্ত) যে ফল আসেনি, দ্বিতীয় বিপ্লবে তা অবশ্যই আসবে। আর তাঁদের সেই কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের সারথি হবেন কায়েস।