জলবায়ু পরিবর্তন: পাকিস্তানের জেকোবাবাদে মায়েদের কঠিন জীবন

প্রচণ্ড গরমে বাঙ্গিখেতে কাজ করছেন অন্তঃসত্ত্বা সোনারি
ছবি: রয়টার্স

পাকিস্তানের জেকোবাবাদ এলাকার একটি বাঙ্গিখেতে কাজ করছেন অন্তঃসত্ত্বা তরুণী সোনারি। মাথার ওপর সূর্যের প্রখর তাপ। পাশেই কাজ করছে কয়েক সপ্তাহ আগে সন্তান জন্ম দেওয়া ১৭ বছর বয়সী কিশোরী ওয়াদেরি। কাছাকাছি জায়গায় ছায়ার মধ্যে বিছানা পেতে সন্তানকে শুইয়ে রেখেছে সে, যেন কেঁদে ওঠামাত্রই তাকে খাওয়ানো যায়। গত মাসে এ জেকোবাবাদ শহরই বিশ্বের উষ্ণতম শহরের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। ২৫ বছর বয়সী সোনারি বলেন, ‘গরমকালে আমরা অন্তঃসত্ত্বারা চাপ বোধ করি।’

পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলের এই নারীদের মতো বিশ্বজুড়ে লাখো নারী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছেন। অসহ্য তাপমাত্রার মধ্যে কাজ করতে বাধ্য হওয়া অন্তঃসত্ত্বা নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রয়টার্স।

২০২০ সালে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে জলবায়ু ও স্বাস্থ্য শিক্ষাবিষয়ক বৈশ্বিক কনসোর্টিয়ামের এক বিশ্লেষণে বলা হয়, যেসব অন্তঃসত্ত্বা নারী দীর্ঘ সময় উচ্চ তাপমাত্রার মধ্যে কাজ করেন, তাঁদের বিভিন্ন জটিলতায় ভোগার ঝুঁকি অনেক বেশি। তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ার কারণে মৃত ও অপরিণত শিশুর জন্মের হার প্রায় ৫ শতাংশ বেড়ে যায়।

১৯৯০–এর দশক থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত করা ৭০টি গবেষণা প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে করা ওই বিশ্লেষণ ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে প্রকাশ করা হয়।

কনসোর্টিয়ামের পরিচালক সেসিলিয়া সোরেনসেন মনে করেন, নারীর স্বাস্থ্যের ওপর বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব পড়ার বিষয়টি প্রচণ্ড উপেক্ষিত। এ নিয়ে যথাযথ তথ্য সংগ্রহ না হওয়ায় নারীদের ওপর এর প্রভাব সম্পর্কে জানা যায় না। এ ছাড়া দরিদ্র নারীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসাও নিতে যান না।

বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর নারীরা বেশি করে উষ্ণতা বৃদ্ধিজনিত ঝুঁকির মধ্যে আছেন। কারণ, এসব দেশের অনেক নারীকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় কিংবা সন্তান জন্ম দেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে কাজে যোগ দিতে হয়। সামাজিকভাবে রক্ষণশীল পাকিস্তানসহ অনেক জায়গাতে নারী খেত–খামারে কাজের পাশাপাশি বাড়িতে গিয়ে গরম স্টোভ কিংবা খোলা লাকড়ির চুলায় রান্না করেন। রান্নাঘরগুলোতে বাতাস চলাচলের তেমন কোনো ব্যবস্থা থাকে না।

শরীর ঠান্ডা করতে তেঁতুলের শরবত পান করছেন এক বয়স্ক নারী
ছবি: রয়টার্স

সোরেনসেন বলেন, বাইরের উচ্চ তাপমাত্রার পাশাপাশি বাড়িতে গিয়ে খোলা চুলার মধ্যে রান্নার সময় যে ধরনের তাপমাত্রার সংস্পর্শে আসতে হয়, তাতে দুইয়ে মিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।

আরও পড়ুন

চরম আর্দ্র তাপপ্রবাহ

বৈশ্বিক উষ্ণতা শিল্পবিপ্লব–পূর্ববর্তী মাত্রার তুলনায় প্রায় ১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো অস্বাভাবিক রকমের তাপমাত্রার মুখোমুখি হয়েছে। আবহাওয়া–বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশনের বিজ্ঞানীদের তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিলে পাকিস্তান ও ভারতে চরম তাপপ্রবাহ দেখা গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমন তাপপ্রবাহের আশঙ্কা ৩০ গুণ বেড়েছে।

আর্দ্রতা যত বেশি থাকে, মানুষের জন্য ঘেমে ঠান্ডা হওয়ার সুযোগ তত বেশি কমে যায়। এ ধরনের অবস্থা নির্ণয় করা হয় ‘ওয়েট বাল্ব টেম্পারেচার’ পদ্ধতির মাধ্যমে। এ পদ্ধতিতে একটি তাপ মাপার যন্ত্রকে (থার্মোমিটার) ভেজা কাপড়ে মুড়িয়ে নিয়ে তাপমাত্রা নির্ণয় করা হয়। ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওয়েট বাল্ব টেম্পারেচারকে মানুষের টিকে থাকার সীমারেখা বলে মনে করা হয়।

২০১০ সাল থেকে জেকোবাবাদ এলাকার তাপমাত্রা কমপক্ষে দুবার সে সীমারেখাকে ছাড়িয়ে গেছে। গত ১৪ মে শহরটির তাপমাত্রা ৫১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায়। প্রতিবেদনটি তৈরি করতে গিয়ে জেকোবাবাদের ১২ জনের বেশি নারী বাসিন্দা এবং কয়েকজন উন্নয়ন ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞের সাক্ষাৎকার নিয়েছে রয়টার্স।
সোনারি ও ওয়াদেরি যে বাঙ্গিখেতে কাজ করেন, তার দূরত্ব জেকোবাবাদের প্রাণকেন্দ্র থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার। ওই খেতে আরও কয়েক অন্তঃসত্ত্বা নারী কাজ করছেন। প্রতিদিন সকাল ছয়টায় তাঁদের কাজ শুরু হয়। দুপুরে ঘরের কাজ আর রান্নাবান্নার জন্য অল্প সময়ের বিরতি পান। এরপর আবার কাজ করার জন্য খেতে ফিরে যান তাঁরা। সেখানে সূর্য ডোবা পর্যন্ত কাজ চলে তাঁদের। নবজাতকের মা ও অন্তঃসত্ত্বা নারীরা তাঁদের পায়ে ব্যথা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ও সন্তানকে বুকের দুধ পান করানোর সময় অস্বস্তি হওয়ার কথা জানিয়েছেন।

অসহ্য গরমে কাজ করতে গিয়ে হিট স্ট্রোক

কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন নামের একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে জেকোবাবাদ শহরে তিনটি হিট স্ট্রোক সেবাকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।
গত ১৪ মে জেকোবাবাদ শহরের তাপমাত্রা ৫১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায়। সে সময় বিশ্বের সর্বোচ্চ উষ্ণ শহরে পরিণত হয় এটি। এদিন নাজিয়া নামের স্থানীয় এক নারী তাঁর বাড়িতে আসা অতিথিদের জন্য রান্না করছিলেন। তাঁর রান্নাঘরে কোনো শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্র বা ফ্যান ছিল না। রান্না করতে করতে হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাঁকে কাছাকাছি একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁকে মৃত ঘোষণা করে। হিট স্ট্রোকে তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জেকোবাবাদে প্রচণ্ড গরমজনিত মৃত্যুর রেকর্ড নিয়ে কিছু বলতে রাজি হননি জেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। নাজিয়ার ঘটনাটি নিয়েও কিছু বলেননি তাঁরা।

মৃত্যুর পরদিন নাজিয়াকে কবর দিতে তাঁর লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। নাজিয়ার বড় সন্তানের বয়স পাঁচ বছর আর ছোট সন্তানের বয়স এক বছর।
এমনিতেই দারিদ্র্যকবলিত মানুষ শীতাতপ যন্ত্র কিংবা ফ্যান ব্যবহার করতে পারে না। এ ছাড়া চলে ঘন ঘন বিদ্যুতের আসা-যাওয়া।

গাধায় টানা গাড়িতে করে বাড়িতে বাড়িতে পানিভর্তি কনটেইনার বিক্রি করা হচ্ছে
ছবি: রয়টার্স

এ ধরনের উষ্ণতা থেকে নারীদের বাঁচাতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। খোলা চুলার বদলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি দিয়ে পরিচালিত স্টোভ ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নারীদের চিকিৎসা ও সামাজিক সেবাগুলো ভোরে কিংবা সন্ধ্যায় দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কারণ, ওই সময় আবহাওয়া অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা থাকে। আবার ঘরবাড়িতে যেন সূর্যের বিকিরণ না পৌঁছাতে পারে, তার জন্য ব্যবহার করতে হবে ঠান্ডা থাকার উপকরণযুক্ত টিনের চালা।

পানির সংকট

জেকোবাবাদ শহরজুড়ে বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত কিছু পানির পাম্প আছে। সেখান থেকে গাধায় টানা গাড়িতে করে ২০ লিটারের কনটেইনার ভর্তি করে পানি নিয়ে বাড়িতে বাড়িতে বিক্রি করা হয়। জেকোবাবাদের বেশির ভাগ বাসিন্দা এ ধরনের পানি সরবরাহের ওপর নির্ভর করে থাকে। একটি পরিবারের সামান্য আয়ের পাঁচ ভাগের এক ভাগ বা আট ভাগের এক ভাগ পর্যন্ত এ পানি কিনতেই শেষ হয়ে যায়।

ছয় মাস বয়সী সন্তানের মা রাজিয়া বলেন, তাঁর মেয়ে যখন দুপুরের গরমে কেঁদে ওঠে, তখন তার গায়ে কিছুটা পানি ছিটিয়ে দেন। এরপর তাকে একটি ফ্যানের সামনে বসিয়ে দেওয়া হয়। আস্তে আস্তে শান্ত হয় সে।

স্থানীয় কর্মকর্তারা বলেন, বিদ্যুৎ–সংকটের কারণে পানির এ ঘাটতি তৈরি হয়। কারণ, বিদ্যুৎ না থাকলে পানি বিশুদ্ধকরণের কাজ করা যায় না এবং পাইপ দিয়ে তা শহরজুড়ে সরবরাহ করা যায় না।

রাজিয়ার প্রতিবেশী রুবিনা বলেন, তিনি গরমের মধ্যে খোলা চুলায় রান্নার সময় বারবার পানি দিয়ে নিজেকে ভিজিয়ে নেন, যেন অজ্ঞান না হয়ে যান। অনেক সময় গায়ে ছিটানোর মতো যথেষ্ট পানিও থাকে না।

রুবিনা জানান, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কিনতে যাওয়ার আগেই পানি ফুরিয়ে যায়। এর জন্য অপেক্ষা করতে হয় তাঁদের। রুবিনা বলেন, ‘গরমের দিনে ঘুম থেকে উঠেই দেখি—পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই, তখন শুধু খোদাকে ডাকি আমরা।’