জান্তাবিরোধীরা বিল দেওয়া বন্ধ করায় মিয়ানমারে বিদ্যুৎ–সংকট

গত ফেব্রুয়ারির শুরুতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর থেকে দেশটিতে বিক্ষোভ চলছে।
ছবি: রয়টার্স

মিয়ানমারে জান্তাবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিদ্যুৎ বিল দেওয়া বন্ধ করা হয়েছে। এতে বিদ্যুৎ খাতে রাজস্ব আদায় কমে বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে।

দেশটিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়ে শহরগুলোতে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে।

করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের মধ্যে এ বিদ্যুৎ–সংকটে দেশটির স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক সমস্যা হচ্ছে। বর্তমানে দেশটিতে গড়ে দৈনিক ৬ হাজার নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে। করোনা শনাক্ত মোট রোগীর সংখ্যা আড়াই লাখ ছাড়িয়েছে, মোট মৃত্যু হয়েছে ৬ হাজার মানুষের। জুনের মাঝামাঝিতে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়েছে। তবে মিয়ানমারে পরীক্ষা খুব সীমিত হওয়ায় করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।  

গত ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন এনএলডি সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে। এরপর থেকেই প্রতিবাদ হিসেবে জনগণের একটি বড় অংশ বিদ্যুৎ বিল দেওয়া বন্ধ করে দেয়। তাতে আগের বছরের তুলনায় গত ফেব্রুয়ারি থেকে দেশটির বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের রাজস্ব প্রায় ৯০ শতাংশ কমে গেছে।

জাপানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নিক্কি এশিয়ার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, এ–বিষয়ক মিয়ানমারের সরকারি তথ্য দেখেছে তারা। তা ছাড়া মিয়ানমার নিয়ে কাজ করা অর্থনীতিবিদদের গ্রুপ ইনডিপেনডেন্ট ইকোনমিস্ট ফর মিয়ানমার-আইইএমের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনেও এ চিত্র উঠে এসেছে।

মিয়ানমারে চিকিৎসাব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখা সরকারি হাসপাতালগুলোও এ বিদ্যুৎ–সংকট থেকে রেহাই পাচ্ছে না। কাজ চালিয়ে যেতে জেনারেটর চালাতে বাধ্য হচ্ছে তারা। এমন সময়ে তাদের এ পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে, যখন দেশটিতে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েই চলেছে।

আইইএমের প্রতিবেদনে বলা হয়, জান্তা সরকার ক্ষমতা দখলের পর থেকেই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় বিদ্যমান অবকাঠামো চালিয়ে নিতে ধুঁকছে। সংকটের মধ্যেই তাদের বিদ্যুৎ খাতের বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে হওয়া চুক্তির শর্তগুলো মেনে চলতে হচ্ছে। নতুন প্রকল্পও নেওয়া হয়েছে।

জান্তা সরকার জ্বালানি খাতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারও এনেছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ডিজিটাল মিটার, বিদ্যুৎ যাওয়ার আগের সতর্কব্যবস্থা, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, নতুন অবকাঠামো নির্মাণ এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে অগ্রসর হওয়ার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।

এদিকে জান্তাবিরোধী গণবিক্ষোভে অংশগ্রহণের কারণে চাকরিচ্যুতি এবং স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কারণে গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় ৪ হাজার ৫৮ জন কর্মী হারিয়েছে। দেশটিতে বিদ্যুৎ–সংকট দীর্ঘস্থায়ী এবং তা অনেকটা ‘স্বাভাবিক ঘটনা’ হয়ে উঠছে বলে আইইএমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের সাবেক একজন কর্মকর্তা জানান, জান্তা সরকার ক্ষমতা দখলের আগে মন্ত্রণালয়ে প্রায় ৫০ হাজার কর্মী ছিল। এর মধ্যে ৪ হাজার কর্মীর বিদায়ের বড় প্রভাব রয়েছে। কারণ, এসব কর্মীর মধ্যে মধ্যম সারির ব্যবস্থাপক, টেকনিক্যাল এবং রাজস্ব সংগ্রহের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা রয়েছেন।

আইইএমের প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা–সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ক্ষেত্রে শুল্ক হ্রাস, নতুন গ্যাসক্ষেত্রের ব্যয় বৃদ্ধি এবং বিদ্যুৎ বিল দেওয়া বন্ধ হওয়ায় সরকার কয়েক শ কোটি ডলার রাজস্ব হারিয়েছে। এতে বোঝা যায় যে জনগণের একাংশ বিদ্যুতের পাশাপাশি অন্যান্য বিল ও কর দেওয়া বন্ধ করায় তা বহু পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ঠিকমতো পরিচালনায় সরকারকে বেকায়দায় ফেলবে।

করোনা সংক্রমণ লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকায় এরই মধ্যে বেসামাল জনস্বাস্থ্য খাতের ওপর বিদ্যুৎ–সংকটের বড় প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। মিয়ানমারের বিগত সরকারে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের অর্থনীতিবিদ টিম ডোবারম্যান। তিনি নিক্কি এশিয়াকে বলেছেন, মিয়ানমারে সীমিত সংখ্যক আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর রয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হলে সেগুলো পরিচালনা হুমকিতে পড়তে পারে। ডোবারম্যান বলেন, হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকলে গুরুতর অসুস্থ রোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চলে গেলে স্বাস্থ্যসেবা হুমকিতে পড়বে, এটা রোগীদের মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।