জাপানে কার্ল মার্ক্সের ফিরে আসা

জাপানের তরুণদের মধ্যে সাড়া ফেলেছে ‘এনথ্রোপসিনের কালে ক্যাপিটাল’। ইতিমধ্যে বইটির আড়াই লাখ কপি ছাপা হয়েছে
ছবি: সংগৃহীত

গোলাকার একটি ত্রিভুজ আঁকা কি সম্ভব? এই প্রশ্ন রেখেছেন জাপানের তরুণ গবেষক কোহেই সাইতো, গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত ‘এনথ্রোপসিনের কালে ক্যাপিটাল’ নামে তাঁর নিজের রচিত গ্রন্থে। প্রশ্নের উত্তরও তিনি নিজে সেখানে দিয়েছেন। সাইতোর বক্তব্য হচ্ছে, আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজে জাতিসংঘের নির্ধারিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন করতে পারা অনেকটাই হচ্ছে গোলাকার এই ত্রিভুজ আঁকার মতোই।

এনথ্রোপসিন হচ্ছে সময়ের একটি ধারণা, কোথায় এর শুরু এবং কোথায় শেষ, তা নিয়ে বিতর্ক থেকে গেলেও সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা হচ্ছে, ১৯৪৫ সালে আণবিক বোমার প্রথম পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ থেকে এই সময়কালের সূচনা, যা এখনো চলমান। সে রকম অর্থেই কোহেই সাইতো তাঁর বইয়ের শিরোনামে সময়ের এই সংজ্ঞাকে ব্যবহার করেছেন। আর ক্যাপিটাল অর্থে পুঁজি বুঝিয়ে থাকলেও কার্ল মার্ক্সের ‘ডাস ক্যাপিটাল’কেই তিনি আলোচনায় নিয়ে এসেছেন।

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত নানা সমস্যা জটিলতর হতে থাকার পাশাপাশি করোনাভাইরাস মহামারি মানুষে মানুষে এবং অন্যদিকে বিভিন্ন জাতিসত্তার মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য অনেক বেশি বিস্তৃত করে দিচ্ছে। কার্ল মার্ক্স তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থে পুঁজিবাদী সমাজের এই সীমাবদ্ধতার ইঙ্গিত অনেক আগেই দিয়েছিলেন। মানবজাতির সামনে নতুন করে দেখা দেওয়া এই দুঃসময়ে জাপানে কার্ল মার্ক্স এখন নতুন অনুসারীদের খুঁজে পাচ্ছেন এবং এদের অনেকেই তরুণ প্রজন্মের সদস্য। আর করোনাকালে শুরু হওয়া এই ‘মার্ক্স বুমের’ পেছনে চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে সাইতোর বই।

এ বছর জানুয়ারি মাসে জাপানের সম্প্রচারমাধ্যম এনএইচকে কার্ল মার্ক্সের ওপর তাত্ত্বিক আলোচনার এক অনুষ্ঠানে সাইতোকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। সেখানে তিনি বক্তব্য দেন। এরপর থেকেই সাইতোর বইয়ের কাটতি বেড়ে যায় এবং করোনা মহামারির সংকট ঘনীভূত হতে থাকা অবস্থায় বেস্টসেলারের তালিকায় জায়গা করে নেয় বইটি। সাইতোর বইটি নিয়ে পাঠকের আগ্রহ বেড়ে যাওয়ায় জাপানে বইয়ের জন্য নামী দোকান মারুজেন ক্রেতা ও পাঠকদের আকৃষ্ট করতে আলাদা একটি জায়গা সাজিয়েছে। যেখানে সাইতোর বইয়ের পাশাপাশি কার্ল মার্ক্সের ওপর সাম্প্রতিক সময়ে জাপানে প্রকাশিত অন্যান্য বইও সেখানে রাখা হয়েছে।

এনএইচকের সেই অনুষ্ঠানে দেওয়া সাইতোর বক্তব্য তরুণ প্রজন্মের অনেককেই আকৃষ্ট করে। অবাক হওয়ার দিকটি হচ্ছে, স্নায়ুযুদ্ধের কোনো স্মৃতি এদের নেই এবং ১৯৬০–এর দশকের বামপন্থী ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কেও কিছুই এদের প্রায় জানা নেই। এর বাইরে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পর থেকে কার্ল মার্ক্স সম্পর্কে যেটুকু তাঁরা জানতে পেরেছেন, তার সবটাই হচ্ছে নেতিবাচক। এরপরও মার্ক্স তাঁদের টানছে। তরুণ পাঠকেরা সাইতোর বইয়ের একটি সহজ সংস্করণ প্রকাশের অনুরোধও এনএইচকের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রকাশনা সংস্থাকে জানিয়েছিল। তাঁদের সেই অনুরোধে সাড়া দিয়ে বইটির একটি সহজপাঠও কিছুদিন আগে বাজারে এসেছে।

৩৪ বছর বয়সী কোহেই সাইতো ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ-সমাজবিদ্যার সহযোগী অধ্যাপক। জাপানের কিওদো বার্তা সংস্থাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘করোনাভাইরাস মহামারি চলাকালীন সামাজিকভাবে দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়া লোকদের অবস্থা দেখা অনেকেই এখন পুঁজিবাদী সমাজের নানা রকম বৈসাদৃশ্য সহজেই অনুধাবন করতে পারছেন।’

এ রকম এক চরম বৈষম্যমূলক সমাজ থেকে বের হয়ে আসার যে সুপারিশ সাইতো তাঁর বইয়ে করেছেন, সেটার তিনি নাম দিয়েছেন ‘উল্টোমুখী প্রবৃদ্ধির কমিউনিজম’, মার্ক্সের মূল সাম্যবাদী ধারণা থেকে যেটা উদ্ভূত। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চাইতে বরং সামাজিক ও পরিবেশগত কল্যাণ ও শুভবোধের ওপর অগ্রাধিকার প্রদান করার মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদের আওতাধীন ব্যাপক উৎপাদন ও গণভোগবাদী ব্যবস্থার বিরামহীন চক্রের গতি রোধ করতে সক্ষম সমাজ।

জাপানে সাইতোর বইয়ের ক্রেতা ও পাঠকের বড় একটা অংশের বয়স ২০ ও ৩০–এর ঘরে। পরিবেশ নিয়ে তাঁদের অনেকেই আজকাল বেশ সচেতন। তরুণদের এই চিন্তাভাবনা সাইতোকে তাঁদের কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে। সাইতো তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে পরিবেশসংকটকে মার্ক্স দেখেছিলেন পুঁজিবাদী অর্থনীতির স্বভাবগত প্রবণতা হিসেবে এবং জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে পরিবেশের ওপর পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থার বিধ্বংসী পরিণাম নিয়ে তিনি খুবই সচেতন হয়ে উঠেছিলেন।

‘এনথ্রোপসিনের কালে ক্যাপিটাল’ বইয়ের আড়াই লাখ কপি ইতিমধ্যে ছাপা হয়েছে। ‘২০২১ সালের নতুন বই’ ক্যাটাগরিতে পুরস্কৃত হয়েছে বইটি। বার্তা সংস্থা কিওদোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাইতো বলেছেন, ‘ভবিষ্যতের দিকে সব রকম সমস্যা ঠেলে দেওয়ার শেষ সীমানায় এসে আমরা এখন উপস্থিত হয়েছি।’ ফলে পরিবর্তন এখন আবশ্যকীয় হয়ে উঠেছে বলে তাঁর ধারণা এবং তিনি মনে করেন নতুন গণজাগরণই পারে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন নিয়ে আসতে। সেই গণজাগরণের ঢেউ জনসংখ্যার ৩ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ অহিংস প্রতিবাদের পথে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হবে। তিনি মনে করেন, ৩ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ অহিংস পথে জেগে উঠলে সমাজ বদল করা সম্ভব এবং নিজের কাজের মধ্য দিয়ে সেটাই তিনি উৎসাহিত করতে চাইছেন।