জাপানে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী: এখনই গলছে না বরফ
জাপান-চীন সম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়ে ভালো যাচ্ছে না। চীনের ভাষ্য, যুক্তরাষ্ট্রের উসকানিতে জাপান সাড়া দিয়ে যাচ্ছে। এতে তাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপরই কেবল কালো ছায়া ফেলছে না, একই সঙ্গে এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতাকেও হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। অন্যদিকে চীনের ক্রমাগত সামরিক বল বৃদ্ধি এবং পূর্ব চীন সাগরে জাপানের নিয়ন্ত্রিত ও মালিকানাধীন কয়েকটি ক্ষুদ্র দ্বীপের চারপাশে চীনা নৌবাহিনীর উসকানিমূলক তৎপরতায় জাপান উদ্বিগ্ন ও বিরক্ত। এর প্রভাব এসে পড়েছে দুই দেশের সম্পর্কের অন্যান্য দিকের ওপরও। জাপানের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার চীন হওয়া সত্ত্বেও দেশটির জনগণের মধ্যে চীন সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব বাড়ছে। চীনেও অনেকটা একই অবস্থা লক্ষ করা যাচ্ছে।
সে রকম পরিস্থিতিতে দুই দিনের সফরে গতকাল মঙ্গলবার জাপানে এসেছেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। টোকিও এসেই জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তোশিমিৎসু মোতেগির সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করেন। আর টোকিও ছাড়ার আগে আজ বুধবার সন্ধ্যায় জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগার সঙ্গে সংক্ষিপ্ত বৈঠক করেন। দুই বৈঠককেই তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প–পরবর্তী সময়ে জাপান-চীন সম্পর্ক কোন অবস্থায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে, তার কিছু আভাস হয়তো এর মধ্য দিয়ে পাওয়া যেতে পারে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী টোকিও আসার আগে অনেকেই ধারণা করেছিলেন, এই সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের টান টান সম্পর্কে কিছুটা হলেও হয়তো বরফ গলবে। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ততটা আশাবাদী হওয়ার মতো পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি।
দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর গতকালের বৈঠকে তাঁরা কয়েকটি বিষয়ে সম্মত হলেও দক্ষিণ চীন সাগর প্রশ্নে ভিন্ন অবস্থানেই ছিলেন। ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন ছাড়া জাপান ও চীন উভয় দেশের ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যিক ভ্রমণে অনুমতি দিতে সম্মত হয়েছে দুই দেশ। বিশ্বের যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন ও জাপান করোনা মহামারিতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মূলত তারা তাদের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবসায়ীদের জন্য এই পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ ছাড়া করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রেও তারা পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়ে রাজি হয়েছে।
তবে ভূখণ্ডগত প্রশ্ন, বিশেষ করে পূর্ব চীন সাগরের দ্বীপমালা নিয়ে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অবস্থান ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। মোতেগি জাপানের অবস্থান পরিষ্কারভাবে তুলে ধরে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানালেও দ্বীপগুলোর ওপর চীনের সার্বভৌমত্ব রক্ষার অঙ্গীকার ব্যক্ত করার বাইরে আর কিছু বলেননি ওয়াং।
আজ সন্ধ্যায় ওয়াং জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে আবারও পূর্ব চীন সাগরের প্রশ্নটি আলোচনায় আসে। সেনকাকু দ্বীপমালার মালিকানা নিয়ে জাপানের অবস্থানকে বেইজিং অবজ্ঞা করায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সুগা বলেছেন, প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে স্থিতিশীল সম্পর্ক কেবল অঞ্চলের জন্যই নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্যও উপকারী বলে বিবেচিত হবে। প্রায় ২০ মিনিট ধরে চলা আলোচনায় সুগা হংকংয়ের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
এটা ছিল সুগার দায়িত্ব গ্রহণের পর চীনের কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁর প্রথম বৈঠক। গত সেপ্টেম্বরে সুগা দায়িত্ব নেন। বৈঠক শেষে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, টোকিওর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের অপেক্ষায় বেইজিং। তিনি বলেন, পূর্ব চীন সাগর নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক এতে প্রতিবন্ধক হওয়া উচিত নয়। তিনি আরও বলেন, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের একটি বার্তা তিনি সুগার কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। চীনের প্রেসিডেন্ট ওই বার্তায় করোনাভাইরাস সামাল দিতে সহযোগিতার প্রস্তাব রাখার পাশাপাশি দ্রুত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার লাভের আশা ব্যক্ত করেছেন। এ ছাড়া স্থগিত হয়ে যাওয়া ২০২০ টোকিও অলিম্পিকের আয়োজনে চীনের সমর্থনের বিষয়টিও বার্তায় উল্লেখ করা হয় বলে ওয়াং জানান।
সার্বিক বিবেচনায় ওয়াংয়ের সফর দুই দেশের বরফ গলাতে না পারলেও সীমিত ভ্রমণ সুবিধার মধ্য দিয়ে কিছুটা হলেও অগ্রগতি নিশ্চিত করেছে। সেই পথে ভবিষ্যতে হয়তো আরও অগ্রগতি দেখা যেতে পারে। উভয় দেশ এখন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প-পরবর্তী বাইডেন প্রশাসন পররাষ্ট্রনীতিতে কোন অবস্থান নেয়, তা দেখার অপেক্ষায় রয়েছে।