তালেবান কি সেই রূপ দেখাবে, শঙ্কায় প্রবাসী হাজারারা

আফগানিস্তানে দীর্ঘদিন ধরে জাতিগত নিগ্রহের শিকার হয়ে আসছে শিয়া মতাবলম্বী হাজারা সম্প্রদায়ের মানুষ। রাজধানী কাবুলের উপকণ্ঠে একটি মসজিদে জুমার নামাজ আদায়রত এ সম্প্রদায়ের মানুষফাইল ছবি: এএফপি

তালেবানের ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে আফগানিস্তানে বসবাসরত শিয়া মতাবলম্বী হাজারা সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদের শঙ্কা, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ শাসনামলের মতো যদি তারা আবার জাতিগত নিগ্রহের শিকার হয়। আফগানিস্তানের তেমনই এক চিত্র ফুটে উঠেছে ইরাকের নাজাফে অবস্থানরত হাজারা সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের বক্তব্যে।

বর্তমানে আফগানিস্তানের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৪ কোটি। এর মধ্যে ১০ থেকে ২০ শতাংশ হাজারা সংখ্যালঘু।

ইরাকের নাজাফে বসবাসরত আফগান হাজারা সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীরা বলছেন, তাঁরা নিজেরা বেশ নিরাপদে রয়েছেন, কিন্তু তাঁদের সব ভয় আফগানিস্তানে বসবাসরত তাঁদের পরিবার নিয়ে। তাঁরা কী করবেন, বুঝতে পারছেন না। তাঁরা পরিবারের কাছে ফিরে যাবেন, নাকি পরিবারকে ইরাকে নিয়ে আসবেন, তা-ও বুঝতে পারছেন না। আর এসব কাজ সহজও নয়।

ঐতিহাসিকভাবেই আফগানিস্তানে পশতুনদের দ্বারা নিগ্রহের শিকার হয়ে আসছে হাজারা সম্প্রদায়। আর কঠোরে সুন্নিপন্থী তালেবান মূলত পশতুন সংখ্যাগরিষ্ঠই। ধারণা করা হয়, উনিশ শতকের শেষ দিকে আফগানিস্তান থেকে অর্ধেক হাজারা দেশান্তরিত হয়। এমনকি ৯/১১-এর পর মার্কিন প্রশাসন আফগানিস্তানের হস্তক্ষেপ করার পরও সুন্নি উগ্রপন্থীদের দ্বারা হাজারা নিগ্রহ থামেনি।

হজরত আলী (রহ.)-এর সমাধি নাজাফে। প্রতিবছর সেখানে লাখ লাখ শিয়া মতাবলম্বী যাতায়াত করে থাকে। সেখানে শিয়া আদর্শ প্রচারের লক্ষ্যে জ্ঞানকেন্দ্র রয়েছে। তেমনই এক জ্ঞানকেন্দ্রে অধ্যয়নরত শেখ আলী বাশির নামের ৫১ বছর বয়সী এক আফগান হাজারা। তাঁর বক্তব্যে উঠে এসেছে, আফগানিস্তানের নতুন শঙ্কার কথা।

আলী বাশির বলেন, ‘আমি আফগানিস্তানের মানুষের কল্যাণে কাজ করতে চাই। আমি সেখানে ফিরে যেতে চাই। কিন্তু সেখানকার অবস্থা মোটেও অনুকূলে নেই।’ বাশির নিজের পরিবার নিয়ে এখনো ততটা উদ্বিগ্ন হচ্ছেন না। তিনি বলেন, ‘আমার ভাই ও বোনেরা আফগানিস্তানে। রাজধানী কাবুল থেকে বেশ দূরে তাদের বসবাস। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ। তারা এখনো নিরাপদে আছে।’ তবে তিনি মুঠোফোনে একটি ভিডিও দেখিয়ে নিজের সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, গত মাসে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর হাজারাদের একটি বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়। কিন্তু সহিংস আক্রমণের মাধ্যমে ওই বিক্ষোভ ভন্ডুল করে দেন তালেবান যোদ্ধারা।

নাজাফে অধ্যয়নরত শেখ মুহাম্মাদ তাকি নামের এক আফগান হাজারা যুবক বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি নিজের পরিবারকে আফগানিস্তানের হেরাত প্রদেশ থেকে ইরাকে নিয়ে আসতে চাইছেন। তাঁর ভাষ্য, ‘আমার মা, বোন ও স্ত্রী এখনো সেখানে রয়েছেন। তাঁদের বিষয়ে ভীষণ চিন্তিত...একজন নারী স্বামী ছাড়া ঘর থেকে দূরে কোথাও যেতে পারেন না। কিন্তু তাঁদের ভ্রমণের জন্য (ইরাকে গমন) কীভাবে ভিসা-পাসপোর্ট পেতে হয়, তা আমাদের জানা নেই। সেখানে আমাদের সাহায্য করার মতোও কেউ নেই।’

আরেক হাজারা যুবক শেখ কুরবান আলী বলেন, তিনি নিজ এলাকা আফগানিস্তানের মাজার-ই-শরিফে যেতে চাইছেন। কিন্তু সেখানে বর্তমানে যে অবস্থা বিরাজ করছে, তা তাঁর মতো শিক্ষার্থীদের অনুকূলে নয়। তিনি বলেন, যদি নাজাফের শিয়া নেতারা বাড়ি ফিরে যেতে বলেন, তাহলে তিনি যথাসম্ভব ফেরার চেষ্টা করবেন।

২০০১ সালের মার্চে তালেবান আফগানিস্তানে বিখ্যাত বামিয়ান বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস করে। এর কয়েক দিনের মাথায় তালেবান সেখানে বিখ্যাত এক হাজারা নেতার মূর্তিও ধ্বংস করে। ওই সময় প্রতিনিয়ত হাজারাদের ওপর সুন্নি কট্টরপন্থীদের নিগ্রহ চলমান ছিল। ২০০১-এর মে মাসে হাজারা জেলায় এক বালিকা বিদ্যালয়ের কাছে ৫০ জনকে হত্যা করা হয়। ২০ বছর পর আবার তালেবানের ক্ষমতায় ফেরা পুরোনো ক্ষতগুলো মনে করিয়ে দিচ্ছে নাজাফে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মতো অন্য হাজারাদেরও।