‘তায়কোয়ান্দো নয়, তালেবানের কাছে খেলায় হেরে গেছি’

হেরাতে প্রায় ১৩০ নারী তায়কোয়ান্দো খেলোয়াড় রয়েছেন। তাঁদের বয়স ১২ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে
ছবি: এএফপি

আফগানিস্তানের তায়কোয়ান্দো খেলোয়াড় জারগুনা নুরি। ২২ বছর বয়সী এই নারী একসময় স্বপ্ন দেখতেন আফগানিস্তানের হয়ে অলিম্পিক গেমসে প্রতিনিধিত্ব করার। সে সুযোগ আসার আগেই খেলায় হেরে গেছেন তিনি। তবে তায়কোয়ান্দো খেলায় হারেননি নুরি। তাঁর ভাষায়, ‘এখন আমরা সবাই তালেবানের কাছে হেরে গেছি।’

আফগানিস্তানের হেরাত শহরের বাসিন্দা নুরি। সেখানে থেকে বার্তা সংস্থা এএফপির সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘কোনো ম্যাচে যখন আমি হেরে যেতাম, তখন এক ভয়ংকর অনুভূতি হতো।’ এখনকার অনুভূতিও সে রকম।

১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তালেবান। এরপর চলতি মাসের শুরুতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছে তারা। এ সরকারে কোনো নারী প্রতিনিধি নেই। উল্টো নারীবিষয়ক মন্ত্রণালয় বিলুপ্ত করেছে তালেবান। আর এ মন্ত্রণালয়ের জায়গায় নতুন একটি দপ্তর করা হয়েছে নীতিনৈতিকতা–বিষয়ক। মূলত ধর্মীয় অনুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এটি কাজ করবে।

নারীরা খেলাধুলায় অংশ নিতে পারবেন কি না, এ বিষয়ে এখনো কোনো নীতি ঘোষণা করেনি তালেবান। তবে এ নিয়ে ইতিমধ্যে মন্তব্য করেছেন সংগঠনটির নেতারা। তাঁরা ইঙ্গিত দিয়েছেন, ঢালাওভাবে সব খেলায় নারীরা অংশ নিতে পারবেন না।

তালেবান ক্ষমতায় আসার পরই নারীদের ওপর বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, নারীরা খেলাধুলায়ও অংশ নিতে পারবেন না।

এ নিয়ে হতাশ নুরির মতো খেলোয়াড়েরা। এক দশক আগে আফগানিস্তানের প্রাদেশিক দলে যোগ দিয়েছিলেন নুরি। এরপর ২০১৮ সালে জাতীয় পর্যায়ের শিরোপা জিতেছেন। খেতাব পেয়েছেন ‘বেস্ট লিডারের’। কিন্তু এখন তিনি বলছেন, ‘আমাদের জীবন একেবারে বদলে গেছে।’

নুরি বলেন, ‘আমাদের তায়কোয়ান্দো দলের প্রত্যেক সদস্য স্বপ্ন দেখেন, তাঁরা একদিন আফগানিস্তানের পতাকা হাতে অলিম্পিকে যাবেন। কিন্তু এখন প্রত্যেকে বাসায় থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রতিদিনই আরও হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছেন তাঁরা।’

আফগানিস্তানে তায়কোয়ান্দো দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কারণ, এ খেলায় ২০১৮ সালে বেইজিং অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন রাউল্লাহ নিকপাই। এ ছাড়া জাকিয়া খুদাদাদিও (২২) রয়েছেন তায়কোয়ান্দো জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে। সর্বশেষ টোকিও প্যারা-অলিম্পিকে অংশ নিয়েছিলেন তিনি।

আফগানিস্তানে নারী খেলোয়াড়দের জন্য পরিবেশ বৈরী। শুধু গ্রাম নয়, শহরেও এমন পরিস্থিতি। হেরাতে প্রায় ১৩০ নারী তায়কোয়ান্দো খেলোয়াড় রয়েছেন। তাঁদের বয়স ১২ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। কিন্তু সম্প্রতি তাঁদের জিমে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। ফলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, খেলোয়াড় হিসেবে তাঁদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। গত সপ্তাহে তালেবানের নতুন ক্রীড়ামন্ত্রী বশির আহমেদ রুস্তমজাই বলেছেন, তালেবান ৪০০ ধরনের খেলার অনুমোদন দেবে। এর মধ্যে নারীদের অংশগ্রহণে কোনো খেলার অনুমোদন থাকবে কি না, তা নিশ্চিত নয়। বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন তালেবানের সংস্কৃতিবিষয়ক কমিশনের নেতা আহমাদুল্লাহ ওসিক। তিনি বলেন, নারীদের খেলাধুলার প্রয়োজন নেই।

তালেবান সরকারের এমন ইঙ্গিতে হতাশ আফগানিস্তানের নারী খেলোয়াড়েরা। সেই তায়কোয়ান্দো খেলোয়াড় জারগুনা নুরির কথাতেই ফেরা যেতে পারে। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন এই খেলোয়াড়। তিনি বলেন, আফগানিস্তানের প্রত্যেক নারী স্বপ্ন দেখেন এগিয়ে যাওয়ার। ভবিষ্যতে তাঁরা নিজেদের ভালো অবস্থানে দেখতে চান। তিনি আরও বলেন, ‘তাঁরা সবাই রোলমডেল হতে চান। তাই তাঁরা বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে চান, আমরা কতটা এগিয়েছি।’

নুরি বলেন, ‘আমরা সবাই কাজ করেছি, চর্চা করেছি। আমরা আমাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু এখন এসবের কিছুই করা হচ্ছে না।’ নুরির মতো অনেক তায়কোয়ান্দো খেলোয়াড় এখন লুকিয়ে আছেন। তবে তাঁরা মাঠে ফেরার জন্য মরিয়া। এই মাঠে ফেরা যে খুব সহজ নয়, ইতিমধ্যেই বুঝতে পেরেছেন তাঁরা। এটাও বুঝতে পারছেন, তাঁদের দেশ ছাড়তে হতে পারে। কিন্তু নুরির বক্তব্য হলো, কেউ নিজের দেশ তো ছাড়তে চায় না। তাই মাঠে ফিরতে আন্তর্জাতিক মহলের সাহায্য চেয়েছেন তাঁরা।