এগিয়ে রাইসি, ভোটার উপস্থিতি কম

ইরানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দিচ্ছেন এক নারী। দেশটিতে আজ সকাল থেকে ভোট গ্রহণ শুরু হয়েছে। চলবে মধ্যরাত পর্যন্ত।ছবি: রয়টার্স

জনমত জরিপে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন কট্টরপন্থী রক্ষণশীল নেতা ইব্রাহিম রাইসি। রাইসি দেশটির বিচার বিভাগের প্রধান। তিনি ইরানের শীর্ষ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। স্থানীয় সময় আজ শুক্রবার সকাল থেকে সেখানে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। ভোট গ্রহণ চলবে আজ মধ্যরাত পর্যন্ত।

এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের লড়াইয়ে এখন পর্যন্ত এগিয়ে রয়েছেন রাইসি। নির্বাচনে বিজয়ী হলে তিনি হবেন ইরানের অষ্টম প্রেসিডেন্ট। আগামী আগস্টে তিনি বর্তমান প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির কাছ থেকে ক্ষমতা বুঝে নেবেন। স্থানীয় সময় আগামীকাল শনিবার দুপুর নাগাদ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হতে পারে বলে এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়।

তেহরানে একটি ভোটকেন্দ্রে ভোট দিচ্ছেন ইব্রাহিম রাইসি।
ছবি: রয়টার্স

অন্য সময়ের তুলনায় এবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট গ্রহণ তুলনামূলক কম হবে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আগেই এমন আভাস দেওয়া হয়েছিল। এএফপি বলছে, আজ ৪৩ শতাংশের নিচে ভোট পড়বে। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের চেয়ে এই হার অনেক কম।

পারমাণবিক প্রকল্পকে কেন্দ্র করে কয়েক বছর ধরে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা ইরানের এবারের নির্বাচন শুধু জাতীয় পর্যায়ে নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। কেননা, ভিয়েনায় ছয় বিশ্বশক্তির সঙ্গে নতুন করে আলোচনা শুরু করেছে তেহরান। পারমাণবিক প্রকল্প থেকে সরে আসা, বিনিময়ে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া—এটা নিয়ে চলছে দর-কষাকষি। তাই এই আলোচনার ভাগ্য নির্ধারণে ইরানের পরবর্তী রাজনৈতিক নেতৃত্ব বড় ভূমিকা রাখবে, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।

তেহরানে নির্বাচনে প্রথম ভোট দেন আয়াতুল্লাহ খামেনি।
ছবি: রয়টার্স

তেহরানে নির্বাচনের প্রথম ভোটটি দেন আয়াতুল্লাহ খামেনি। দেশের প্রায় ছয় কোটি ভোটারকে তিনি ভোট দিতে উৎসাহিত করেন।

৮১ বছর বয়সী ইরানের এই সর্বোচ্চ নেতা বলেন, ‘আপনি যত দ্রুত নিজের দায়িত্ব পালন করবেন ততই মঙ্গল। ভোট ইরানের জনগণের ভবিষ্যৎ গড়তে সাহায্য করবে।’
খামেনির এই প্রেরণাদায়ক বক্তব্য ইরানের সাধারণ মানুষকে ভোট দিতে কতটা উৎসাহী করেছে সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। দেশটির সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক অবস্থা, বেকারত্বের হার, যা মহামারির কারণে আরও খারাপ হয়েছে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া একের পর এক নিষেধাজ্ঞা ইরানের দশা আরও করুণ করে ফেলেছে। এসবের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশটির জনগণ তাঁদের রাজনৈতিক নেতাদের দায়ী করছেন। সে জন্যই তাঁরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না বলে এএফপি বলছে।
তেহরানের এক গাড়ি মেরামতকারী নাসরোল্লাহ এএফপিকে বলেন, ‘আমি রাজনীতিবিদ না। রাজনীতির বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আমার টাকা নেই। পরিবারের সদস্যরা অর্থনৈতিক সমস্যায় ভুগছেন। এই পরিস্থিতির জন্য যারা দায়ী, তাদের কী করে ভোট দিই? এটা ঠিক না।’

ভোটার উপস্থিতি কম থাকলেও অনেকই আগ্রহ নিয়ে ভোট প্রদান করেন।
ছবি: রয়টার্স

এর মধ্যে অনেককেই আবার আগ্রহ নিয়ে ভোটকেন্দ্রে যেতে দেখা গেছে বলে এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়। ভোটারদের অনেকে ইরানের জাতীয় পতাকা নিয়ে ভোট দিতে যেতে দেখা যায়।

ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডের পোশাক পরে এক নারী এসেছেন ভোট দিতে। সঙ্গে তাঁর দুই ছেলেকেও নিয়ে এসেছেন। সাহেবিয়ান নামে এক নার্স এসেছেন ভোট দিতে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘোষণা দেওয়ায় তিনি রাইসিকে সমর্থন করছেন। তিনি বলেন, রাইসি দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেবেন এবং মানুষকে অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে উদ্ধার করবেন। রাইসি দেশ থেকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বঞ্চনা দূর করবেন বলেও তিনি বিশ্বাস করেন।

ভোটার উপস্থিতি কম। কিন্তু যারা ভোট দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে নারী ভোটারদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো।
ছবি: এএফপি

পরপর দুবার দেশটির প্রেসিডেন্টের পদে আছেন রুহানি। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকায় তিনি এবার নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি।

ভোট প্রদানের পর রুহানি বলেন, ‘যা কিছুই হোক নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। সমস্যা থাকা সত্ত্বেও আমাদের কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়া উচিত।’ ভোটকেন্দ্রে আরও বেশি ভোটার উপস্থিতি প্রত্যাশা করেন বলে মন্তব্য করেন রুহানি।

ইরানে ১৯৭৯ সালের পর থেকে দেশের শীর্ষ ধর্মীয় নেতাই সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। কিন্তু আমলাতন্ত্রের প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে ভূমিকা রাখেন প্রেসিডেন্ট। ইরানের বাণিজ্যিক নীতি থেকে বিদেশ নীতি ঠিক করার ক্ষেত্রেও প্রেসিডেন্টের ভূমিকা থাকে।
এবারের নির্বাচন ঘিরে শুরু থেকে নাটকীয় পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে ইরানের রাজনীতি। দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদসহ কয়েকজনের মনোনয়ন বাতিল হয়েছে আগেই। ভোট গ্রহণের প্রাক্কালে গত বুধবার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন তিনজন। তাঁরা হলেন পারমাণবিক চুক্তিতে দেশটির সাবেক আলোচক সায়েদ জালিলি, আইনপ্রণেতা আলিরেজা জাকানি ও সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহসিন মেহেরআলিজাদেহ। এর মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য ভোটের লড়াইয়ে টিকে রয়েছেন চারজন প্রার্থী।

ইব্রাহিম রাইসি

ইব্রাহিম রাইসি।
ছবি: রয়টার্স

ইরানের প্রধান বিচারপতি ইব্রাহিম রাইসি। এবারের নির্বাচনে দেশটির শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ও রক্ষণশীল রাজনীতিকদের সমর্থন পেয়েছেন তিনি। তাই ধারণা করা হচ্ছে, ভোটের ফলে চূড়ান্ত হাসি তিনিই হাসবেন। তিনি ২০১৭ সালের নির্বাচনেও প্রেসিডেন্ট হতে লড়েছিলেন। হাসান রুহানির বিরুদ্ধে জয় পাননি। তবে ভোট পেয়েছিলেন ৩৮ শতাংশ। ২০১৯ সালে বিচার বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় তাঁকে। ৬০ বছর বয়সী রাইসিকে ইরানের পরবর্তী শীর্ষ নেতার পদে অন্যতম দাবিদার বিবেচনা করা হয়। নির্বাচনী প্রচারে তিনি ভোটারদের সামনে নিজেকে ‘দুর্নীতি, অদক্ষতা ও অভিজাতদের’ ঘোরবিরোধী হিসেবে তুলে ধরেছেন।

আবদুল নাসের হেমাতি

আবদুল নাসের হেমাতি।
ফাইল ছবি, রয়টার্স

নিজেকে মধ্যপন্থী ও বাস্তববাদী হিসেবে পরিচয় দেন আবদুল নাসের হেমাতি। পেশাগত জীবনের শুরুতে হেমাতি ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সাংবাদিকতা করেছেন। দেশটির ব্যাংক ও বিমা খাতের প্রভাবশালী মুখ তিনি। পরে তিনি ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হন। দেশটির অর্থনীতির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার চাপ সামলাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তবে প্রেসিডেন্ট হওয়ার লড়াইয়ে নামায় হাসান রুহানি তাঁকে পদ থেকে সরিয়ে দেন। এবারের নির্বাচনে ৬৪ বছরের হেমাতিকে অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিবেচনা করা হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, ভোটের লড়াইয়ে রাইসি ও হেমাতির মধ্যে মূল লড়াই হবে। তিনি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে সরাসরি বৈঠকে বসতে আগ্রহী।

মহসিন রেজাই

মহসিন রেজাই।
ফাইল ছবি, রয়টার্স

ইরানের শীর্ষ নেতার মনোনয়ন পাওয়া সাংবিধানিক এক্সপেনডিয়েন্সি কাউন্সিলের প্রধান হিসেবে ১৯৯৭ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করে আসছেন মহসিন রেজাই। ছিলেন ইরানের গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান। ইসলামি রেভল্যুশনারি গার্ডের (আইআরজিসি) কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে ১৬ বছর কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। ৬৬ বছর বয়সী এই সাবেক সামরিক কর্মকর্তা ও কট্টরপন্থী রাজনীতিক মনে করেন, ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর দুঃখ প্রকাশ করা উচিত।

আমির হোসেন ঘাজিজাদ্দেহ হাসেমি

আমির হোসেন ঘাজিজাদ্দেহ হাসেমি
ফাইল ছবি, রয়টার্স

ইরানের এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সবচেয়ে কম বয়সী প্রার্থী আমির হাসেমি। ৫০ বছর বয়সী রক্ষণশীল ঘরানার এই রাজনীতিক পেশায় চিকিৎসক। নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ। টানা চার মেয়াদে দেশটির আইনপ্রণেতা হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। ইরানের বর্তমান পার্লামেন্টে ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্ব সামলেছেন। ক্ষমতায় গেলে অপেক্ষাকৃত তরুণদের নিয়ে সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।