নওয়াজের বিরুদ্ধে ‘বড় গলা’ করা ইমরানের ঘনিষ্ঠরাই এখন আলোচনায়

ইমরান খান ও নওয়াজ শরিফ

২০১৬ সালে প্রকাশ হওয়া পানামা পেপারসে বিভিন্ন দেশের নেতাদের আর্থিক কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়। সেই তালিকায় নাম ছিল পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পরিবারের সদস্যদের। ওই ঘটনায় কপাল পোড়ে নওয়াজ শরিফের। আদালতের আদেশে পরের বছর জুলাইয়ে তাঁকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়। সে সময় বিষয়টি নিয়ে খুবই সোচ্চার ছিলেন ক্রিকেট তারকা থেকে রাজনীতিতে আসা ইমরান খান, যিনি দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী।

পানামা পেপারসে পাকিস্তানের নওয়াজ শরিফের ছেলে-মেয়েদের অফশোর কোম্পানিতে বিনিয়োগের তথ্য প্রকাশের পর ইমরান খান বলেছিলেন, এটা ‘আল্লাহর আশীর্বাদ’ হিসেবে এসেছে। নওয়াজ শরিফকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেছিলেন, ‘দুর্নীতিবাজদের জোট’ পাকিস্তানকে ডোবাচ্ছে।

প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে রাজনীতির মাঠে সুবিধা আদায়ের জন্য ইমরান খান আরও বলেছিলেন, অফশোর অ্যাকাউন্ট বা পশ্চিমা দেশগুলোতে অর্থ চলে যাচ্ছে। দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হচ্ছে। দরিদ্র দেশগুলো আরও দরিদ্র হচ্ছে এবং ধনী দেশগুলো আরও ধনী হচ্ছে। অফশোর অ্যাকাউন্টগুলো এই জালিয়াতি টিকিয়ে রাখছে।

ওই ঘটনার পাঁচ বছর পর গত রোববার প্যান্ডোরা পেপারস নামে বিশ্বের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের গোপন লেনদেনের তথ্য ফাঁস করেছে বিশ্বের অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জোট ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে)। এর মধ্য পাঁচ বছর পর একই ধরনের ঘটনা ফিরে এসেছে পাকিস্তানে। গ্রিক রূপকথা ‘প্যান্ডোরা বক্স’–এর নামানুসারে রাখা প্যান্ডোরা পেপারসে রয়েছে সাত শতাধিক পাকিস্তানির নাম। তাঁদের মধ্যে ইমরান খানের ঘনিষ্ঠ অর্থমন্ত্রী শওকত তারিন এবং ইমরান খানের শীর্ষস্থানীয় একজন অর্থদাতা রয়েছেন। এ ছাড়া পাকিস্তানের পানিসম্পদমন্ত্রী চৌধুরী মুনিস এলাহী, শিল্পমন্ত্রী খুসরো বখতিয়ারের পরিবার, ইমরানের দল পিটিআইয়ের নেতা আবদুল আলিম খানসহ দেশটির সাতজন রাজনীতিবিদের নাম এসেছে।

এ ঘটনার পর ইমরান খানের স্বস্তিতে থাকার কথা নয়। কঠোর সমালোচিত হচ্ছেন তিনি। অনেকে সরাসরি ইমরান খানের পদত্যাগেরও দাবি জানিয়েছেন। পাকিস্তানের অন্যতম বিরোধী দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেতা আইনপ্রণেতা শাহজিয়া মারি ইমরানের ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’ দিতে ভোলেননি। সোমবার জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শাহজিয়া বলেছেন, পানামা পেপারসে পাকিস্তানিদের নাম আসার পর যেভাবে হইচই শুরু করেছিলেন সেই সময়কার বিরোধী দলের নেতা ইমরান খান, এবার প্যান্ডোরা পেপারসের ক্ষেত্রে তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি।

ইমরান খান অবশ্য প্যান্ডোরা পেপারস প্রকাশের পরপরই এটাকে স্বাগত জানান। তিনি বলেন, ‘এটা প্রকাশের মাধ্যমে বিদেশে গুপ্ত অর্থ মজুতকারীদের নাম প্রকাশ পেয়েছে। কোনো ধরনের অনিয়মের ঘটনা ঘটলে আমরা উপযুক্ত পদক্ষেপ নেব।’

তবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস আসলে কতটা বাস্তবে রূপ নেবে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বিস্তর। কারণ, ইমরান খানের ঘনিষ্ঠদের নাম প্যান্ডোরা পেপারসে আসার পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে ইমরান খানের সোচ্চার হওয়ার স্লোগানকে আর বিশ্বাস করতে পারছেন না বিরোধী দলের নেতারা। অনেকে মনে করছেন, আসলে এসব স্লোগান লোকদেখানো আর ক্ষমতায় টিকে থাকার উপায় মাত্র। ইমরান খানের জবাবদিহির স্লোগান ‘মেকি’ কি না, সে প্রশ্ন তুলেছেন পিপিপির নেতা আরেক নেতা শেরি রেহমান।

তবে এটা বলতেই হয়, পানামা পেপারসে নওয়াজের পরিবারের সদস্যদের নাম আসার পর বিরোধীরা যেভাবে রাজনীতির মাঠ গরম করার চেষ্টা করেছিল, এবার সেই পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে ইমরান খানকে চাপে রাখার চেষ্টা করছেন বিরোধীরা নেতারা।

গত সোমবার বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হয়েছে। খবরে বলা হয়েছে, প্যান্ডোরা পেপারসে যেসব মন্ত্রী ও তাঁদের সহযোগীদের নাম এসেছে, তাঁদের পদত্যাগে বাধ্য করা এবং সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে নওয়াজ শরিফের দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ (পিএমএল-এন)। বর্তমানে পিএমএল-এন পাকিস্তানের প্রধান বিরোধী দল।

পানামা পেপারসে সরাসরি নওয়াজ শরিফ বা তাঁর ছোট ভাই শাহবাজ শরিফের নাম ছিল না। তাঁদের পরিবারের সদস্যদের যুক্তরাজ্য ও বিশ্বের অন্যান্য দেশে গোপন সম্পদের তথ্য প্রকাশ পেয়েছিল সেখানে। সে ঘটনার সঙ্গে বর্তমান ঘটনা এখন মেলানোর চেষ্টা করছেন বিরোধী নেতারা। পিএমএল-এনের নেতারা বলছেন, নওয়াজের নাম না থাকার পরও তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য অযোগ্য করা হয়েছিল। একই সঙ্গে ইমরান খানের নাম না এলেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের নাম ঠিকই রয়েছে প্যান্ডোরা পেপারসে। তাই ইমরানও একই দোষে দোষী। তিনি দায় এড়াতে পারেন না।

তবে প্যান্ডোরা পেপারস কেলেঙ্কারি পাকিস্তানের রাজনীতিতে ২০১৭ সালের মতো প্রভাব সৃষ্টি করতে পারবে না বলে মনে করছেন কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তাঁদের একজন ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান উড্রো উইলসন সেন্টার ফর স্কলার্সের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুজেলম্যান বলেছেন, ‘আমি মনে করি না পাকিস্তানের রাজনীতিতে বড় কোনো প্রভাব ফেলবে বিষয়টি। কারণ, প্রতিবেদনে ইমরান খানের নাম নেই। একই সঙ্গে প্রতিবেদনটি প্রকাশের পরপরই ইমরান খান এর প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন এবং তদন্ত করার কথা বলেছেন।’

তবে পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক মেহমাল সরফরাজ বলেছেন, প্যান্ডোরা পেপারসে নাম আসা ব্যক্তিদের মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে না দিলে, তা সরকারকে সমস্যায় ফেলতে পারে।

প্যান্ডোরা পেপারসে আরও পাকিস্তানির নাম
মঙ্গলবার পাকিস্তানের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ডনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্যান্ডোরা পেপারসে আরও পাকিস্তানির নাম এসেছে। সেই তালিকায় মিডিয়ার মালিক থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্য, ব্যবসায়ী ও কোম্পানির নির্বাহীদের নাম উঠে এসেছে।

আইসিআইজে উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম নিউজ ইন্টারন্যাশনালের অনুসন্ধানী সাংবাদিক উমর চিমা ও ফখর দুরানি। সোমবার নিউজ ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জং গ্রুপের এডিটর ইন চিফ মির শাকিলুর রহমান, ডনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হামিদ হারুন ও এক্সপ্রেস মিডিয়া গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুলতান আলীও বিদেশে অফশোর কোম্পানির মালিক। পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও পাকিস্তান টুডের সম্পাদক প্রয়াত আরিফ নিজামির নামও রয়েছে প্যান্ডোরার তালিকায়। পাঞ্জাবের সাবেক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) খালিদ মকবুলের জামাতা আহসান লতিফের নাম রয়েছে। এ ছাড়া লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মুহাম্মদ আফজাল মুজাফ্ফরের ছেলে মুহাম্মদ হাসান মুজাফ্ফরসহ অনেক সেনা কর্মকর্তার পরিবারের নাম জড়িয়েছে প্যান্ডোরা কেলেঙ্কারিতে।

এ ছাড়া পাকিস্তানের জনপ্রিয় ক্রিকেট টুর্নামেন্টের দল পেশোয়ার জালমির মালিক জাভেদ আফ্রিদি, ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট আরিফ উসমানি, ন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আদনান আফ্রিদিসহ আরও অনেকের নাম এসেছে নতুন করে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স, ডয়চে ভেলে, ডন ও আইসিআইজের দেওয়া তথ্য অবলম্বনে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন কামরুজ্জামান