নাকবা দিবস: মহাবিপর্যয় থেকে মুক্তি পায়নি ফিলিস্তিনিরা

গাজায় ইসরায়েলি হামলার সময় জাতীয় পতাকা হাতে ফিলিস্তিনের একজন বালক
ফাইল ছবি: এএফপি

সময়টা ১৯৪৮ সালের ১৪ মে। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করে ইহুদিদের জন্য নতুন একটি রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। যুক্তরাজ্য সরকারের সহায়তায় গঠিত নতুন রাষ্ট্রটির নাম রাখা হয় ইসরায়েল। ইহুদিদের মতে, নতুন রাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে তাঁরা ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত ভূমিতে ফিরে এসেছে। এই ভূমি তাঁদের।

ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর দিন থেকেই স্থানীয় আরব অধিবাসীদের ওপর নেমে আসে মহাবিপর্যয় বা আল-নাকবা। ইহুদি সশস্ত্র গোষ্ঠী ও সেনারা ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য হত্যা-ধর্ষণ-লুট-অগ্নিসংযোগ শুরু করে। প্রাণভয়ে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি বাড়িঘর, সহায়-সম্পত্তি ছেড়ে পালাতে থাকে। প্রায় সাড়ে ৭ লাখ ফিলিস্তিনি জর্ডান, লেবানন ও সিরিয়ায় গিয়ে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নেয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার হলোকাস্টের নির্মম স্মৃতি তখনো তাড়া করে ফিরছিল ইহুদিদের। এর পরও অনেকটা একই ধাঁচে ফিলিস্তিনিদের ভূমি জোরপূর্বক দখল করার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয় ইসরায়েল রাষ্ট্রের। শুরু হয় আরব–ইসরায়েল যুদ্ধ। দখল করে নেওয়া হয় ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের প্রায় ৭৮ শতাংশ। ভূমিপুত্র আরবদের বসবাস শুধু পশ্চিম তীর ও গাজায় সীমিত হয়ে যায়। আর এক অনিঃশেষ অনিশ্চয়তার মধ্যে পতিত হয় ফিলিস্তিনিরা, যা আজও চলছে। এই কারণে প্রতিবছর ১৫ মে ফিলিস্তিনিরা নাকবা দিবস বা মহাবিপর্যয়ের দিন হিসেবে পালন করে।

সর্বশেষ গত বছর গাজায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় ইসরায়েল। জাতিসংঘের হিসাবে, ২০২১ সালের ১০ মে থেকে ২১ মে পর্যন্ত চলা হামলায় প্রাণ হারান ৬৭ শিশুসহ ২৪১ জন। আহত হন ২ হাজার ২০০–এর বেশি মানুষ। তাই বলা যায়, ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের জীবনে যে আল-নাকবা বা চরম বিপর্যয় শুরু হয়েছিল, তা এখনো থামেনি।

প্রথম আরব–ইসরায়েল যুদ্ধ চলে ১৯৪৯ সালের শুরুর সময় পর্যন্ত। ইসরায়েল ও পশ্চিম তীরের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সীমানা (গ্রিন লাইন) নির্ধারণ করে দেওয়ার শর্তে লড়াই থামে। যদিও পরে শর্ত অমান্য করে ইসরায়েল। ১৯৬৭ সালের দ্বিতীয় আরব–ইসরায়েল যুদ্ধ ও এর জেরে ফিলিস্তিনিদের বসতি আরও সংকুচিত করে ফেলা হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ইস্যুতে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল করে ইহুদি বসতি স্থাপনের প্রক্রিয়া চলমান রেখেছে।

আরও পড়ুন

১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ সালের মধ্যে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী প্রধান প্রধান ফিলিস্তিনি শহরগুলোয় হামলা করে। ধ্বংস করা হয় প্রায় ৫৩০টি গ্রাম। এসব ঘটনায় প্রাণ হারান ১৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল দেইর ইয়াসিন শহরে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ। ১৯৪৮ সালের ৯ এপ্রিল ইসরায়েলি বাহিনী জেরুজালেমের পশ্চিমাঞ্চলের এই শহরে হামলা চালিয়ে একদিনে নারী ও শিশুসহ ১১০ জনের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে।

সর্বশেষ গত বছর মে মাসে গাজায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় ইসরায়েল
ছবি: রয়টার্স

ইসরায়েলি ধ্বংসযজ্ঞের এসব ঘটনা নিয়ে একটি বই লিখেছেন ফিলিস্তিনি গবেষক সালমান আবু সিত্তা। ‘দি অ্যাটলাস অব প্যালেস্টাইন’ নামের বইটিতে তিনি ইসরায়েলি দখলদারিত্ব ও হত্যাযজ্ঞ এবং এর জেরে ফিলিস্তিনিদের জীবনে চরম বিপর্যয় নেমে আসার ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন। এতে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি দখলদারিত্বে উদ্বাস্তু হয়ে প্রায় ৬০ লাখ ফিলিস্তিনি বাড়িঘর ছেড়েছেন। তাঁরা এখন ফিলিস্তিন ও প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশের অন্তত ৫৮টি শরণার্থী শিবিরে বংশ পরম্পরায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।

ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করা জাতিসংঘের ত্রাণ সহায়তা দপ্তর ইউএনআরডব্লিউএ বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে তাঁদের খাবার, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার মতো প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করছে। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, তারা জর্ডানে ২৩ লাখ, গাজায় ১৫ লাখ, অধিকৃত পশ্চিম তীরে প্রায় পৌনে ৯ লাখ, সিরিয়ায় ৫৭ হাজার ও লেবাননে ৪ লাখ ৮০ হাজার ফিলিস্তিনি শরণার্থীকে নিয়মিত সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরগুলোর মধ্যে আকারের দিক থেকে বড় জর্ডানের বাকা, গাজার জাবালিয়া, অধিকৃত পশ্চিম তীরের জেনিন, সিরিয়ার ইয়ারমৌক এবং লেবাননের এল হিলওয়েহ। এর মধ্যে গাজার আটটি শিবিরে প্রায় ১৫ লাখ উদ্বাস্তুর বসবাস। গাজার মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশের বেশি উদ্বাস্তু। আন্তর্জাতিক আইনে শরণার্থীদের নিজ ভূমিতে ফিরে যাওয়ার ও নিজেদের সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। তাই ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের অনেকে এখনও আশা করেন, একদিন ইসরায়েলি দখলদারিত্বের অবসান ঘটবে। তাঁরা নিজ ভূমিতে ফিরতে পারবে।

ইসরায়েলি আগ্রাসন ও ফিলিস্তিনিদের প্রতিবাদ চলছে সাত দশকের বেশি সময় ধরে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ফিলিস্তিনের প্রত্যেক মানুষের ওপর ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রচ্ছন্ন নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। বসবাস, বিয়ে, ভ্রমণ থেকে শুরু করে জীবন যাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁদের ইসরায়েলি বাহিনীর প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ মেনে চলতে হয়। বেসরকারি সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে ইসরায়েল। সংস্থাটির তদন্তে ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের ভূমি ও সম্পত্তি দখল, বেআইনিভাবে হত্যা, আটকে রেখে নির্যাতন, অবরোধ আরোপ, বাধ্যতামূলক স্থানান্তরের হাজারো প্রমাণ উঠে এসেছে।

আরও পড়ুন

এদিকে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক সমন্বয়ক সংস্থা ওসিএইচএ–এর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ফিলিস্তিনি মালিকানাধীন অন্তত ৮ হাজার ৪১৩টি স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। এসব ঘটনায় উদ্বাস্তু হয়েছে ১২ হাজার ৪০০ এর বেশি মানুষ। সংস্থাটি আরও জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে অধিকৃত পশ্চিম তীরের ৭৯ শতাংশ স্থাপনা নিজেদের দখলে নিয়েছে ইসরায়েল। পূর্ব জেরুজালেমের ২০ শতাংশ স্থাপনা ইসরায়েলের দখলে গেছে। এ ছাড়া ১৬০ শিশু ও ৩২ নারীসহ ৪ হাজার ৪৫০ জন ফিলিস্তিনিকে বেআইনিভাবে ইসরায়েলে আটক রাখা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক আইনে ইহুদি বসতি স্থাপনা নিষিদ্ধ। তবে তা মানতে নারাজ ইসরায়েল। বেআইনিভাবে অধিকৃত পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে সাড়ে ৭ লাখ ইহুদিকে বসতি গড়ে দিয়েছে ইসরায়েল সরকার। এসব এলাকায় ভূমিপুত্র আরব ও ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে প্রায়শই দখলদার ইহুদিদের বিরোধ ও সংঘাতের ঘটনা ঘটে। বসতি স্থাপনকারী ইহুদিদের জন্য ইসরায়েল সরকারের আলাদা তহবিল আছে। এমনকি মূল ইসরায়েলের তুলনায় এসব জায়গায় বসবাসকারী ইহুদিদের সন্তান নেওয়ার প্রবণতাও বেশি।

জাতিসংঘের হিসাবে, ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ফিলিস্তিনি মালিকানাধীন অন্তত ৮ হাজার ৪১৩টি স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। এসব ঘটনায় উদ্বাস্তু হয়েছে ১২ হাজার ৪০০ এর বেশি মানুষ।

গত সাত দশকের বেশি সময়ে ফিলিস্তিনের সঙ্গে চারটি যুদ্ধ করেছে ইসরায়েল। এসব যুদ্ধে ৪ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ গেছে। এদিকে ২০০৭–২০০৮ সালে গাজা উপত্যকায় সমুদ্র ও আকাশপথে অবরোধ করে রেখেছিল ইসরায়েল। এই উপত্যকার সঙ্গে ইসরায়েল ও মিসরের সীমান্ত রয়েছে। গাজার আয়তন মাত্র ৩৬৫ বর্গকিলোমিটার, যা দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন কিংবা ভারতের লক্ষ্ণৌয়ের সমান। আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও এই উপত্যকা বেশ জনবহুল। দিনে দিনে জনসংখ্যা বাড়লেও ইসরায়েলি দখলদারিত্বে ছোট হচ্ছে গাজার আয়তন। এজন্য গাজাকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘উন্মুক্ত কারাগার’ বলেন অনেকেই।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ গত বছর গাজায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় ইসরায়েল। জাতিসংঘের হিসাবে, ২০২১ সালের ১০ মে থেকে ২১ মে পর্যন্ত চলা হামলায় প্রাণ হারান ৬৭ শিশুসহ ২৪১ জন। আহত হন ২ হাজার ২০০–এর বেশি মানুষ। তাই বলা যায়, ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের জীবনে যে আল-নাকবা বা চরম বিপর্যয় শুরু হয়েছিল, তা এখনো থামেনি। তাই প্রতিবছর শুধু ঐতিহ্য মেনে ফিলিস্তিনিরা নাকবা দিবস পালন করেন এমনটা নয়। বরং অসহায় ফিলিস্তিনিরা প্রাণের তাগিদে, নিজেদের বেঁচে থাকা ও দখলদারিত্ব থেকে মুক্তির তাগিদে এই দিবস পালন করেন।

আল–জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন অনিন্দ্য সাইমুম ইমন