পাঠাগার যায় ঘোড়ার পিঠে

রিদওয়ান সুরুরি ঘোড়ায় করে বই নিয়ে এসেছেন। শিশুরা সেখান থেকে বই নিচ্ছে। ছবি: এএফপি
রিদওয়ান সুরুরি ঘোড়ায় করে বই নিয়ে এসেছেন। শিশুরা সেখান থেকে বই নিচ্ছে। ছবি: এএফপি

টগবগ করে ছুটে যায় সাদা ঘোড়া। পিঠে বইয়ে ঠাসা ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার। আরেকটি ঘোড়ায় সওয়ারি কানাওয়ালা টুপি পরা রিদওয়ান সুরুরি। তাঁদের সাড়াশব্দ পেলেই দুদ্দাড় ছোটে শিশুরা। তাদের কলরবে কান পাতা দায় হয়। ঘোড়া থামে। শিশুরাও এসে ঘিরে ধরে ঘোড়াকে। নতুন বইয়ের গন্ধ নিতে নিতে, আনন্দে নাচতে নাচতে বাড়ি ফেরে।

ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের বানটেন প্রদেশের সেরাং গ্রামে এমন মধুর দৃশ্য চোখে পড়ে। প্রত্যন্ত এই গ্রামের শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে সপ্তাহের নির্দিষ্ট একটি দিনে বইয়ের ঝাঁপি নিয়ে পৌঁছায় সাদা মাদি ঘোড়া লুনা। তার পিঠে থাকে বইগুলো। সুরুরি লুনার সামনে আরেকটি ঘোড়ায় চড়েন। সুরুরি ঘোড়া ছোটান। তাঁর পেছনে ছুটতে থাকে লুনা।

সেরাং গ্রামে পৌঁছে একটি মসজিদের পাশে লুনাকে বেঁধে রাখা হয়। লুনার জিনে শিকল দিয়ে বাঁধা বড় বড় দুটি কাঠের বাক্স। এই বাক্সে পাঠাগারের বই।

লুনা এলেই শিশুরা গোল হয়ে ঘিরে ধরে তাকে। সুরুরি তাদের লাইনে দাঁড়াতে বলেন। সবার হাতে একে একে তুলে দেন নতুন বই। শিশুরা পছন্দ করে নিজেদের বই নিতে পারে। তবে শর্ত রয়েছে। নতুন বইটি নিতে হলে আগের সপ্তাহে নেওয়া বইটি ফেরত দিতে হবে। আর বইগুলো পড়তে হবে সযত্নে। বাচ্চারা আনন্দের সঙ্গেই এসব শর্ত মেনে নেয়।

বই নেওয়ার জন্য লুনা নামের ঘোড়াটিকে সাজাচ্ছেন সুরুরি। ছবি: এএফপি
বই নেওয়ার জন্য লুনা নামের ঘোড়াটিকে সাজাচ্ছেন সুরুরি। ছবি: এএফপি

বইয়ের হিসাবের খাতায় কড়া নজর রাখেন সুরুরি। একটি বাচ্চা আগের বই আনতে ভুলে গেছে। সুরুরি তাকে শর্তের কথা মনে করিয়ে দেন। বাচ্চাটি জিব কাটে। দৌড়ে বাড়ি যায় পুরোনো বই আনতে। জমা দিয়ে নতুন বই নেয়।

পিঠে বয়ে পাঠাগার নিয়ে ঘোড়াটি এলে আনন্দ কেবল শিশুদের হয় না। বড়রাও কাজ ফেলে ছুটে আসেন। আগ্রহী ব্যক্তিরা বই নিয়ে পড়েন।

সাম্প্রতিক কয়েক বছরে ইন্দোনেশিয়ায় প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে শিক্ষার হার বেড়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুসারে, ২০১৩ সালে শিক্ষার হার ৯৬ শতাংশে পৌঁছায়। তবে অনেকে প্রদেশে শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি। সেন্ট্রাল জাভা শিক্ষার দিক দিয়ে পিছিয়ে। জাভার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে ৫ শতাংশ বা ১০ লাখ মানুষ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত।

সেরাংও এ রকম একটি গ্রাম। খুবই শান্ত। গ্রামভরা ধানখেতে। আগ্নেয়গিরিও রয়েছে সেখানে। তবে সেখানে কোনো গ্রন্থাগার নেই। বই পড়তে হলে শিশুদের অনেক দূরে যেতে হয়। শান্ত এই গ্রামে যখন বইয়ের ঝাঁপি নিয়ে ঘোড়সওয়ারি এসে পৌঁছান, তখন আনন্দের বন্যা বয়ে যায়।

ঘোড়ার পিঠে বই নিয়ে যাচ্ছে ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার। ছবি: এএফপি
ঘোড়ার পিঠে বই নিয়ে যাচ্ছে ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার। ছবি: এএফপি

সুরুরি বলেন, তেমন কোনো পরিকল্পনা ছাড়া হঠাৎ করেই ভ্রাম্যমাণ এই পাঠাগার চালু করেন। ২০১৫ সাল থেকে চালু হয় এটি। এক বন্ধুর কাছ থেকে প্রথমে ১০০টি বই নিয়ে শুরু করেছিলেন। ধীরে ধীরে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার সহায়তায় বইয়ের সংখ্যা বেড়েছে।

বই নিতে এসেছিল ১০ বছরের শিশু আরিফ। বলল, লুনাকে দেখেই তার আনন্দে মন ভরে যায়। এই পাঠাগার থেকে সে ‘ওয়াইল্ড অ্যানিমেলস’ নামের একটি বই নিয়ে পড়েছে। এরপর থেকে ইন্দোনেশীয় পশুপাখির প্রতি আগ্রহ বেড়েছে।

সুরুরি নিজের বাড়ির বাইরে একটি স্থায়ী পাঠাগার গড়ে তুলতে চান। সেখানে অনেক বই থাকবে। একটি কম্পিউটারও থাকবে।