কেন সাবমেরিন পেতে মরিয়া অস্ট্রেলিয়া

অস্ট্রেলিয়ার পারমাণবিক শক্তিচালিত নতুন সাবমেরিন হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সর্বশেষ সংস্করণের সাবমেরিনের মতোই।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল সাবমেরিন তৈরি নিয়ে চুক্তি করেন।
এএফপির ফাইল ছবি

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া নতুন জোট গঠন করেছে। এ চুক্তির মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য মিলিতভাবে অস্ট্রেলিয়াকে পারমাণবিক সাবমেরিন তৈরির সুযোগ করে দিয়েছে। ‘এইউকেইউএস’ নামের এই চুক্তির অধীন অস্ট্রেলিয়াকে পারমাণবিক সাবমেরিনের প্রযুক্তি সরবরাহ করবে ওই দুই দেশ। অস্ট্রেলিয়ার এই সাবমেরিন কেমন হবে? মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন বলছে, অস্ট্রেলিয়ার পারমাণবিক শক্তিচালিত নতুন সাবমেরিন হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সর্বশেষ সংস্করণের সাবমেরিনের মতোই।

অস্ট্রেলিয়া তার উত্তরাঞ্চলীয় জলসীমায় যেকোনো নৌ হুমকি থেকে রক্ষা পেতে মরিয়া হয়ে সাবমেরিন পেতে চাইছে। তাই ফ্রান্সের সঙ্গে অস্ত্র কেনার চুক্তি বাতিল করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে চুক্তি করেছে। এই চুক্তির আওতায় সাবমেরিন পেলে অস্ট্রেলিয়া দক্ষিণ চীন সাগরে নৌবাহিনীর ক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে তারা এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব খর্ব করতে পারবে।

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নৌবহরে এখন মূলত দুই ধরনের সাবমেরিন আছে। একধরনের সাবমেরিন মূলত ‘অ্যাটাক’ বা আক্রমণ কাজের উপযোগী সাবমেরিন। আরেক ধরনের সাবমেরিন হচ্ছে ব্যালিস্টিক মিসাইল বা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ-উপযোগী। এই দুই ধরনের সাবমেরিনই পারমাণবিক শক্তিতে চলে।

অস্ট্রেলিয়া তার উত্তরাঞ্চলীয় জলসীমায় যেকোনো নৌ হুমকি থেকে রক্ষা পেতেই এ ধরনের অস্ত্র ও সাবমেরিন চাইছে। এ ছাড়া এ ধরনের সাবমেরিন তাদের দক্ষিণ চীন সাগরে নৌবাহিনীর ক্ষমতা বৃদ্ধি করবে।

এতে থাকা নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর পানিকে উচ্চ শক্তিসম্পন্ন বাষ্পে পরিণত করে, যা টারবাইন ঘুরিয়ে সাবমেরিন চালু রাখে। তবে ব্যালিস্টিক মিসাইল সাবমেরিনকে অনেক সময় ‘বুমারস’ বলা হয়ে থাকে।

সাবমেরিন থেকে উৎক্ষেপন করা হচ্ছে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র।
ছবি : এএফপি

এসব সাবমেরিনের ব্যবহারও পৃথক। অস্ট্রেলিয়া মূলত বুমারসের চেয়ে অ্যাটাকে আগ্রহ দেখাচ্ছে। তারা পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন বা অ্যাটাক সাবমেরিনের জন্যই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে চুক্তি করেছে। বুমারস সাবমেরিনে পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত থাকে। ব্যালিস্টিক মিসাইলের নিউক্লিয়ার ওয়্যারহেড যুক্ত করা থাকে।

অ্যাটাক সাবমেরিন

অ্যাটাক সাবমেরিন মূলত শত্রু সাবমেরিন খোঁজা এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের জাহাজ খোঁজার ও ধ্বংস করার জন্য নকশা করা হয়। টমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ও স্পেশাল অপারেশন ফোর্সেস (এসওএফ) উপকূলে নৌবাহিনীর ক্ষমতা বাড়াবে।

ভার্জিনিয়া ক্লাস সাবমেরিন
ছবি : রয়টার্স

মার্কিন নৌবাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, অ্যাটাক সাবমেরিন গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও নজরদারি মিশন, যুদ্ধে সেনাবাহিনীকে সাহায্য করা এবং খনিযুদ্ধেও কাজ করে থাকে।

ইন্দো-প্যাসিফিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিবেচনায় অস্ট্রেলিয়া আশা করছে, শিগগিরই তাদের সাবমেরিন নৌবহরে যুক্ত হবে।
থমাস শুগার্ট, মার্কিন নৌবাহিনীর সাবেক সাবমেরিন কমান্ডার

যুক্তরাষ্ট্রের নৌবহরে যে ৫৩টি সাবমেরিন রয়েছে, সেগুলো মূলত তিন ধরনের। এর মধ্যে সবচেয়ে নতুন ১৯টি সাবমেরিন হচ্ছে ‘ভার্জিনিয়া ক্লাসের’। এতে কয়েক ডজন টমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ও টর্পেডো যুক্ত থাকে। ৩৭৭ ফুটের ভার্জিনিয়া ক্লাস সাবমেরিনের ওজন ৮ হাজার টন। এটি ঘণ্টায় ২৮ মাইল বেগে ছুটতে পারে এবং অনির্দিষ্টকাল পানিতে ডুবে থাকতে পারে। এতে ক্রুর সংখ্যা ১৩২। তাঁদের প্রয়োজনীয় রসদ ফুরালেই কেবল ওপরে আসার প্রয়োজন পড়ে।

ইন্দোনেশিয়ার এই সাবমেরিন সত্তরের দশকের শেষ দিকে জার্মানির তৈরি
ফাইল ছবি

এ ধরনের সাবমেরিনে পেরিস্কোপ পর্যন্ত থাকে না। এর বদলে তারা ফটোনিকস মাস্ট নামের বিশেষ ইলেকট্রনিক দণ্ড ব্যবহার করে। এতে যুক্ত থাকে হাই ডেফিনেশন এবং ইনফ্রারেড ভিডিও সুবিধা। এটি যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি এ দণ্ড দিয়েই পর্যবেক্ষণ করতে পারে। এখান থেকে পাওয়া তথ্য কমান্ড সেন্টারের বিশাল পর্দায় প্রদর্শিত হয়। পুরো দৃশ্যটি একটি জয়স্টিক দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

যুক্তরাজ্যের কাছে আছে চারটি অ্যাসটিউট ক্লাস অ্যাটাক সাবমেরিন, এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সাবমেরিনের চেয়ে বেশি গতিসম্পন্ন। এগুলো ঘণ্টায় ৩৫ মাইল পর্যন্ত যেতে পারে। এ ছাড়া এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সাবমেরিনের মতোই টমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতে পারে।

যুক্তরাজ্যের রয়্যাল নেভির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, টমাহক ফোর হচ্ছে ক্ষেপণাস্ত্রের সর্বশেষ সংস্করণ। এর পাল্লা আগের সংস্করণের চেয়ে (এক হাজার মাইল) বেশি। ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার পর এর নতুন লক্ষ্য ঠিক করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া এটি যুদ্ধক্ষেত্রের ছবি তুলেও সাবমেরিনে পাঠাতে পারে।

ব্যালিস্টিক মিসাইল সাবমেরিন

যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের বুমারস সাবমেরিনে ট্রাইডেন্ট ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতে পারে, যাতে একাধিক পারমাণবিক ওয়্যারহেড দিয়ে সজ্জিত থাকে। এর মিশন হচ্ছে সমুদ্রে মাসের পর মাস অবস্থান করা। এ ধরনের সাবমেরিন অধিকাংশ সময়ই পানির নিচে থাকে। শত্রুপক্ষ থেকে কোনো হামলা হলে পাল্টা হামলার জন্য এ ধরনের সাবমেরিন প্রস্তুত রাখা হয়।

বিশ্বের পারমাণবিক শক্তি চালিত সাবমেরিন থাকা সপ্তম দেশে পরিণত হবে অস্ট্রেলিয়া।
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ব্যালিস্টিক মিসাইল সাবমেরিন পানির নিচে এমনভাবে থাকে, যাতে সহজে তা শনাক্ত করা না যায়। যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের প্রতিপক্ষ প্রথম আঘাত হানলে তাদের পরমাণু হামলার জন্য ভয়াবহ মূল্য দিতে হবে।

প্রতিটি মার্কিন ব্যালিস্টিক মিসাইল সাবমেরিন ২০টি ট্রাইডেন্ট ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতে পারে। একেকটি ক্ষেপণাস্ত্রে আটটি ওয়্যারহেড থাকে। যুক্তরাজ্যের সাবমেরিনে ১৬টি ট্রাইডেন্ট ক্ষেপণাস্ত্র ও প্রতিটিতে তিনটি ওয়্যারহেড থাকে। এগুলোর পাল্লা ৪ হাজার ৬০০ মাইল পর্যন্ত হতে পারে। এই পারমাণবিক ওয়্যারহেডগুলোতে ১০০ কিলোটন থেকে ৪৭৫ কিলোটন পর্যন্ত বিস্ফোরণক্ষমতা রয়েছে। জাপানের হিরোশিমায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়েছিল, তার বিস্ফোরণক্ষমতা ছিল ১৫ কিলোটন। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ১৪টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রবাহী সাবমেরিন রয়েছে। যুক্তরাজ্যের কাছে আছে চারটি। তবে এ ধরনের সাবমেরিনের জন্য চুক্তি করেনি অস্ট্রেলিয়া।

কবে সাবমেরিন পাবে অস্ট্রেলিয়া

অস্ট্রেলিয়ার হাতে সাবমেরিন আসতে দীর্ঘ সময় লাগবে। বিশেষ করে তা কয়েক দশক পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। গত বুধবার তিন দেশের যে চুক্তি হয়েছে, তাতে ১৮ মাস ধরে গবেষণা করে অস্ট্রেলিয়ার জন্য উপযোগী সাবমেরিন তৈরির বিষয়টি ঠিক করা হবে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন বলেছেন, অস্ট্রেলিয়ার নৌবহরে নতুন সাবমেরিন যুক্ত হতে ২০৪০ সাল পর্যন্ত লেগে যেতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তাঁর সঙ্গে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন (ডানে) ও অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন (বাঁয়ে)
ছবি: এএফপি

মার্কিন নৌবাহিনীর সাবেক সাবমেরিন কমান্ডার থমাস শুগার্ট বলেন, ইন্দো-প্যাসিফিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিবেচনায় অস্ট্রেলিয়া আশা করছে, শিগগিরই তাদের সাবমেরিন নৌবহরে যুক্ত হবে।

শুগার্ট বলেন, সাবমেরিন তৈরির সময়সীমাকে প্রভাবিত করতে বেশ কিছু বাণিজ্যের বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। স্থানীয় উপাদানের পাশাপাশি স্থায়ী সরবরাহকারী, নতুন নকশা এবং বর্তমান যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের সাবমেরিনের তুলনায় আধুনিক বৈশিষ্ট্য এতে যুক্ত থাকতে হবে।

শুগার্ট আরও বলেন, ‘ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরে ক্ষয়িষ্ণু সামরিক ভারসাম্যের পরিপ্রেক্ষিতে, আমি আশা করব ২০৪০ সালের মধ্যেই নতুন সাবমেরিন দেখা যাবে।’

* সিএনএন অবলম্বনে মিন্টু হোসেন