পুতিনের ভারত সফর বিশ্বরাজনীতির জন্য যে বার্তা দিচ্ছে

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
ছবি: রয়টার্স

রাশিয়ার প্রেসিডেন্টদের ভারত সফর সব সময়ই একধরনের অতীত বিধুরতার আবহের জন্ম দেয়। মস্কো-নয়াদিল্লির সম্পর্কের ইতিহাস বেশ পুরোনো। বিশেষ করে গত শতকের স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকে এই হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কের শুরু। এখন এই সম্পর্ক আরও জোরালো।

দেশ দুটির মধ্যকার সম্পর্ক বৈশ্বিক কূটনীতির সাফল্যের গল্পগুলোর একটি। এমন প্রেক্ষাপটে গতকাল সোমবার সংক্ষিপ্ত সফরে ভারতে যান রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বিশ্বরাজনীতির জন্য পুতিনের এই সফরের অর্থ কী, তা এক বিশেষ প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে বিবিসি অনলাইন।

বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারি শুরুর পর পুতিন দ্বিতীয়বারের মতো বিদেশ সফর করলেন। গতকাল তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন।

উষ্ণ অভ্যর্থনা বা চুক্তি সই—এসবের বাইরে ভারত ও রাশিয়ার সামনে কিছু বড় চ্যালেঞ্জ আছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো দেশ দুটিকে অতিক্রম করতে হবে। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে বিভিন্ন ভূরাজনৈতিক বিষয়ও রয়েছে। মোদি ও পুতিন কীভাবে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করবেন, কীভাবে তার সমাধান করবেন, সেটি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতিকে প্রভাবিত করবে।

এক দশক ধরে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক ক্রমেই বাড়ছে। বিষয়টি দিল্লি-মস্কোর সম্পর্কের ওপর কিছুটা ছায়া ফেলে। বিষয়টি মস্কোর জন্য বিরক্তিকরও বটে।

২০২০ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারত সফরে এসেছিলেন। তখন তাঁর জন্য বড় সমাবেশের আয়োজন করেছিলেন মোদি। এটি ছিল ওয়াশিংটনের প্রতি নয়াদিল্লির সমর্থনের একটি প্রকাশ্য বার্তা।

অন্যদিকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ওয়াশিংটনের সঙ্গে মস্কোর সম্পর্কে ক্রমাগত অবনতি ঘটছে। তা সত্ত্বেও ওয়াশিংটনের সঙ্গে নয়াদিল্লির দহরম–মহরমের মতো বিরক্তিকর বিষয় অনেকটাই উপেক্ষা করে গেছে মস্কো।

কিন্তু ভারত যখন ‘কোয়াড’ জোটে যোগ দেয়, তখন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ প্রকাশ্যে কথা বলেন। কোয়াডে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়াও রয়েছে। তারা বলছে, কোয়াড একটি অসামরিক জোট। কোনো নির্দিষ্ট দেশকে লক্ষ্যবস্তু করে এই জোট গঠন করা হয়নি। কিন্তু এমনটা মনে করেন না লাভরভ।

লাভরভের মতে, পশ্চিমারা ইন্দো-প্যাসেফিক কৌশলে ভারতকে যুক্ত করে চীনবিরোধী খেলায় নয়াদিল্লিকে জড়ানোর চেষ্টা করছে।

সাবেক ভারতীয় কূটনীতিক অনিল ত্রিগুনায়াত একসময় মস্কোতে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বলেন, কোয়াড রাশিয়ার জন্য একটি ‘রেড লাইন’। বিষয়টি অবশ্যই পুতিন ও মোদির মধ্যকার আলোচনায় থাকার কথা।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেইজিংয়ের সঙ্গে মস্কোর ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের প্রেক্ষাপট থেকে কোয়াড নিয়ে রাশিয়ার উদ্বেগের বিষয়টি বোঝা যায়।

অনিল ত্রিগুনায়াত বলেন, রাশিয়া এশিয়ায় তার অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষায় চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য হয়েছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমারা এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করতে চায়।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের অবনতি বেইজিং ও মস্কোকে আরও কাছে নিয়ে এসেছে বলে প্রতীয়মান হয়।

বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছে ভারত ও চীনের মধ্যকার সম্প্রতি উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক। সাম্প্রতিক সময়ে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় দুই দেশের সেনাদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এতে অন্তত ২০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হন। চীন পরে অবশ্য স্বীকার করে যে তাদের কিছু সেনাও এই সংঘর্ষে হতাহত হন।

ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক উইলসন সেন্টারের উপপরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা ভারত ও রাশিয়ার মধ্যকার সম্পর্কের জন্য সম্ভাব্য হুমকি সৃষ্টি করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ভারত ও রাশিয়ার মধ্যকার বিশেষ সম্পর্ক রক্ষায় পুতিনের নয়াদিল্লি সফর গুরুত্বপূর্ণ।

কুগেলম্যান বলেন, তিনি মনে করেন, রাশিয়ার জন্য পুতিনের ভারত সফরের উদ্দেশ্য হলো, নয়াদিল্লির সঙ্গে মস্কোর সম্পর্ককে শক্তিশালী করা।

কুগলেম্যান, ত্রিগুনায়াতসহ বিশ্লেষকেরা মনে করেন, পারস্পরিক উদ্বেগগুলো তুলে ধরার পাশাপাশি তা সমাধানের জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী সম্পর্ক দুই দেশের মধ্যে আছে।

বেশ কিছু ক্ষেত্র রয়েছে, যেখানে ভারত ও রাশিয়া সহযোগী হিসেবে কাজ করতে পারে। এই ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে আফগানিস্তান অন্যতম।

ভারত সফরকালে মোদির সঙ্গে পুতিনের আলোচনায় আফগানিস্তান ইস্যুটি অবশ্যই থাকার কথা। কারণ, নয়াদিল্লি আফগানিস্তানে প্রাসঙ্গিক থাকার চেষ্টা করছে।

অন্যদিকে ভারতের প্রতিবেশী ও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান ইতিমধ্যে আফগানিস্তানে আরও ভালো কৌশলগত অবস্থান রয়েছে। দেশটি রাশিয়া, ইরান ও চীনের সঙ্গে একটি অনানুষ্ঠানিক জোট গঠন করেছে বলে মনে হয়।

আফগানিস্তানে নয়াদিল্লির হারানো অবস্থান পুনরুদ্ধারে ভারতকে সহায়তা করতে পারে রাশিয়া। কারণ, ভারত ও রাশিয়া উভয় দেশই আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক আরএএনডি করপোরেশনের জ্যেষ্ঠ প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ডেরেক গ্রোসম্যান বলেন, তালেবান ও হাক্কানি নেটওয়ার্ক নিয়ে ভারত-রাশিয়ার দুশ্চিন্তা আছে। আফগানিস্তান থেকে নিজ নিজ দেশে সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে পড়াও শঙ্কা আছে দুই দেশের। এ নিয়ে উভয় দেশ সতর্ক। তাই নয়াদিল্লি ও মস্কোর মধ্যকার মতৈক্যের একটি বড় ক্ষেত্র হতে পারে আফগানিস্তান।

ভারত ও রাশিয়া ইতিমধ্যে ব্রিকস, সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা, আরআইসির মতো বহুজাতিক ফোরামের অংশীদার। এই ফোরামগুলো মস্কো ও নয়াদিল্লিকে দ্বিপক্ষীয়ের পাশাপাশি বৈশ্বিক বিষয়ে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ দিচ্ছে। পুতিনের ভারত সফর এই ঘনিষ্ঠতাকে আরও জোরদার করবে।

বিবিসি অবলম্বনে