পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতে এবার দূষিত পানি

ফুকুশিমার পরমাণু কেন্দ্রের দূষিত পানির ট্যাংক
ফাইল ছবি

তেজস্ক্রিয় পানির বিষয়টি জাপানের জন্য নতুন কিছু নয়। ২০১১ সালে ফুকুশিমা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনার পর থেকে সমুদ্রের পানি দূষিত করা নিয়ে জাপানের দিকে অঙ্গুলি তুলে আসছে টোকিওর প্রতিবেশীরা। তারা বলছে, জাপান সরকার নিজের দেশের মানুষকেই কেবল হুমকির মুখে ফেলছে না, সেই সঙ্গে প্রতিবেশীদের জীবনও বিপন্ন করছে।

তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার দোহাই দিয়ে এক দশক ধরে জাপানের ফুকুশিমা জেলা থেকে খাদ্য আমদানি বন্ধ রেখেছে চীন, দক্ষিণ কোরিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশ। পুরোনো সেই বিতর্কে এখন নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে জমা হওয়া তেজস্ক্রিয় দূষণমিশ্রিত পানি সমুদ্রে ছেড়ে দেবে জাপান সরকারের এমন সিদ্ধান্তের পর।

প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগা চলতি সপ্তাহে ঘোষণা দেন এখন থেকে দুই বছরের মধ্যে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে জমা হওয়া পানি শোধন করে সমুদ্রে তা ছেড়ে দেওয়া হবে। এর পরপরই চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া সমগ্র মানবজাতির অভিন্ন ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচিত সমুদ্র দূষিত করার পাঁয়তারা গ্রহণের জন্য জাপানকে দোষারোপ করতে শুরু করে। এমনকি জাপানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে গণ্য তাইওয়ানও এখন সমালোচকদের সারিতে যোগ দিয়েছে।

এই দেশগুলোর অভিযোগ, তেজস্ক্রিয়তা যেহেতু পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব রেখে যায়, ফলে জাপানের শোধন প্রক্রিয়া আসলে কতটা কার্যকর, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। তাই সমুদ্রসম্পদ দূষিত করার মধ্য দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের এক বিস্তৃত এলাকাজুড়ে উপকূলের জনগণের জীবনযাত্রা বিপন্ন করার মতো ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে জাপানের প্রতি জোরালো আহ্বান জানিয়েছে দেশগুলো।

জাপান সরকার অবশ্য এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্তে অনড় এবং বলছে শোধন করে পানিতে যে পরিমাণ তেজস্ক্রিয় ট্রিটেনিয়াম থাকবে, তা হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ করা সুপেয় পানিতে থাকা পরিমাণের চাইতেও অনেক কম।

এদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার বিষয়টি আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন কমিশনের আপস মীমাংসা আদালতে উত্থাপনের জন্য দেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। অন্যদিকে চীন সে রকম পদক্ষেপের কোনো ঘোষণা না দিলেও জাপানের কঠোর সমালোচনা অব্যাহত রেখেছে।

জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী তারো আসো গত মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, তিনি শুনেছেন পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে চুল্লি শীতলীকরণে ব্যবহৃত পানি শোধন করে নেওয়ার পর তা পানের উপযোগী হয়ে ওঠে এবং স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি তা করে না। আসোর এই বক্তব্যের সূত্র ধরে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লি-জান গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘জাপানের একজন কর্মকর্তা উল্লেখ করেছেন যে সেই পানি পান করতে কোনো সমস্যা নেই। আমি তাই তাকে অনুরোধ করব, তিনি যেন কথা না বলে বরং পানি পান করেন।’ ঝাও আরও উল্লেখ করেন যে জাপানের সিদ্ধান্তের মধ্যে পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে দেশটির অজ্ঞতাই কেবল প্রকাশ পায়নি, একই সঙ্গে এক হঠকারী সিদ্ধান্ত, যা কিনা কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

এদিকে ফুকুশিমার স্থানীয় জনগণ, বিশেষ করে মৎস্যজীবীদের সমিতি সরকারের সিদ্ধান্তে হতাশা ব্যক্ত করেছে। ফুকুশিমার কৃষিপণ্য ও মৎস্যসম্পদ বেশ দীর্ঘ সময় ধরে প্রতিবেশী দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকার পর ধীরে ধীরে যখন রপ্তানির দুয়ার আবার উন্মুক্ত হচ্ছিল, সরকারের এই সিদ্ধান্ত সেই প্রক্রিয়াকে আরও একবার পেছনে নিয়ে যাবে বলে তাঁরা মনে করছেন।

জাপান সরকার অন্যদিকে পানি সমুদ্রে ছেড়ে দেওয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পেয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান রাফায়েল মারিয়ানো গ্রসসি জাপানের নাগরিক সম্প্রচার কেন্দ্র এন এইচ কে’কে বুধবার দেওয়া একান্ত এক সাক্ষাৎকারে পক্ষ কিংবা বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণের উল্লেখ না করে বলেছেন, প্রতিবেশীদের উদ্বেগ হ্রাস করার লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞদের একটি দল তিনি দ্রুত জাপানে পাঠাতে চাইছেন। তিনি অবশ্য বলেছেন ট্রিটিয়ামযুক্ত পানি সমুদ্রে ফেলা নিয়ে ফুকুশিমার স্থানীয় জনগণের পাশাপাশি চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো জাপানের প্রতিবেশী দেশগুলোর উদ্বেগ কোনো অবস্থাতেই উপেক্ষা করার মতো নয়।

ফুকুশিমার বিধ্বস্ত পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে জমা হতে থাকে চুল্লি শীতলীকরণে ব্যবহৃত পানির ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেক দিন থেকেই জাপান সরকারকে দুশ্চিন্তায় ভুগতে হচ্ছে। অচিরেই কেন্দ্রে পানি রাখার ধারণক্ষমতা সর্বোচ্চ সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে। সরকার তাই চাইছে এর আগেই যেন পানি সরিয়ে ফেলার একটি ব্যবস্থা ঠিক করে নেওয়া যায়। তেজস্ক্রিয় পানি ব্যবস্থাপনা করে নেওয়ার বিকল্প কয়েকটি উপায় অবশ্য আছে। একটি পথ যেমন পানি বাষ্পীভূত করে নিয়ে আকাশে তা ছেড়ে দেওয়া। অন্য একটি বিকল্প হলো ভূগর্ভে মজুত করে রাখা। তবে এসব বিকল্প খুবই ব্যয়বহুল হওয়ার পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদে পরিবেশের ওপর কতটা ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে, সে বিষয়টি পরিষ্কার না হওয়ায় সহজ এবং তুলনামূলক কম খরচের পথ ধরে জাপান সরকার এখন এগিয়ে যেতে চাইছে। তবে দেশে ও বিদেশে সরকারের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা শুরু হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সেই পথে জাপান সরকার আসলেই এগিয়ে যেতে পারবে কি না, তা অবশ্য এখনো পরিষ্কার নয়।