বাড়ি থেকে পালিয়ে সাগরেই শেষ জীবন!

ফাইল ছবি

নূর কায়াস রোহিঙ্গা কিশোরী। অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে সে–ও আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু শিবিরে জটিলতা, নিরাপত্তাহীনতা, যৌন নির্যাতন ও সহিংসতা তার ভালো লাগত না। এসব থেকে নিজেকে রক্ষা করতে একদিন কাউকে কিছু না বলেই বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল সে।

পালানোর পর থেকে ১৬ বছর বয়সী নূর কায়াসের বেশ খোঁজ করা হয়। কিন্তু কোনো খবর মেলেনি। পরদিন সকালে সে নিজেই একটি ফোনের মাধ্যমে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরে তার মা গুলজানের (৪৩) কাছে ফোন করে। মাকে ফোনে সে জানায়, সে এখন সমুদ্রে। আর ঘরে ফিরবে না। কাঠের ছোট্ট নৌকায় সে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এখন মালয়েশিয়ার পথে। ওই নৌকায় ৬৫ জন নারী, কিশোরীসহ ৮৭ জন রোহিঙ্গা গাদাগাদি করে মালয়েশিয়া যাচ্ছে।

সিএনএনের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, সত্যি সত্যি আর বাড়ি ফেরেনি নিজের দেশ মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া নূর কায়াস। আর কোনো খোঁজও মেলেনি তার। জানা গেছে, দুই মাস থেকে নৌকার অন্য যাত্রীদের সঙ্গে নূরও সমুদ্রে নিখোঁজ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা শিবির থেকে পালানো কয়েকজনের পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, এই করোনা মহামারির সময় কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে যৌন নির্যাতনের মতো ঘটনা বেড়ে গেছে। এ থেকে সবাই মুক্তি পেতে চায়।

ফোনে নূর কায়াস তার মাকে বলেছিল, সে মালয়েশিয়া যাচ্ছে। সেখানে সে ভালো থাকবে। এ কারণে তার মা যেন পাচারকারীকে ৪০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেয়। এ খবর শুনে মা গুলজান হন্যে হয়ে টাকা সংগ্রহের চেষ্টা করতে থাকেন। এরই মধ্যে কাঠের ওই ছোট্ট নৌকায় মালয়েশিয়ার পথে যাত্রা করা সদস্যদের পরিবার খবর পায়, মাঝসমুদ্রে ওই নৌকার ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেছে পাঁচ দিন আগে। পাঁচ দিন ধরে তারা সবাই মাঝদরিয়ায় ভাসছে। কিন্তু সে খবর পাওয়ার পরও দুই মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। ওই নৌকার আর কোনো খোঁজ নেই। নৌকার সদস্যদের কেউ আর কোনো খবর পাঠায় না রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে স্বজনদের কাছে।

ওই নৌকার যাত্রীদের উদ্ধার করার জন্য তাঁদের পরিবার ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো আহ্বান জানিয়েছে। তারা বলছে, সাগরে সাহায্য চেয়ে গত ২০ ফেব্রুয়ারি যাত্রীদের আর্তচিৎকার শুনেছিল ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের ওষুধ, খাবার ও পানি দিয়ে সাহায্য করতে ৪৮ ঘণ্টা সময় নিয়েছিল। এর মধ্যেই নৌকায় থাকা নয়জনের মৃত্যু হয়

নূর কায়াসের মা গুলজান বলেন, ‘আমার মেয়ে বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে, দয়া করে কেউ কি এই খবর আমাকে জানাতে পারবে? সে খুব ভালো মেয়ে। পাচারকারীরা তাকে নৌকায় যাওয়ার জন্য লোভ দেখিয়েছে।’

ওই নৌকার যাত্রীদের উদ্ধার করার জন্য তাঁদের পরিবার ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো আহ্বান জানিয়েছে। তারা বলছে, সাগরে সাহায্য চেয়ে গত ২০ ফেব্রুয়ারি যাত্রীদের আর্তচিৎকার শুনেছিল ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের ওষুধ, খাবার ও পানি দিয়ে সাহায্য করতে ৪৮ ঘণ্টা সময় নিয়েছিল। এর মধ্যেই নৌকায় থাকা নয়জনের মৃত্যু হয়।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা সর্বশেষ ওই নৌকায় গত মার্চের মাঝামাঝি সাহায্য পাঠিয়েছে। এরপর থেকে তারা আর কিছু জানে না। তারা কাউকে তাদের ভূখণ্ডে নামতেও দেয়নি।

অধিকার সংগঠনগুলো বলেছে, নৌকাটি নিখোঁজ হওয়ার পর কক্সবাজারে ওই মালয়েশিয়াগামীদের পরিবারে দুর্ভোগ নেমে এসেছে। এমনিতেই নিরাপত্তার অভাবে এখানে রাতে নারী ও কিশোরীদের ওপর যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) জানিয়েছে, গত কয়েক বছরে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে যৌন নির্যাতন বেড়ে গেছে। এ থেকে রক্ষা পেতে অনেক নারী, কিশোরী ও তরুণী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছোট্ট নৌকায় সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে।

নূর কায়াসের নৌকায় থাকা যাত্রীদের পরিবার, ইউএনএইচসিআর ও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নূর কায়েসসহ প্রায় ৯০ জনকে নিয়ে কাঠের ওই ছোট্ট নৌকাটি গত ১১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের টেকনাফ উপকূল থেকে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে সমুদ্রপথে রওনা হয়। পাচারকারী দলের সদস্যরাও ওই নৌকায় ছিলেন। নৌকাটিতে এক সপ্তাহের খাবার ও পানি ছিল। ১৬ ফেব্রুয়ারি মাঝসাগরে নৌকার ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। এই সময় খাবার ও পানি দ্রুত কমে আসে। গত কয়েক দিন সাগরে ভাসতে ভাসতে ২০ ফেব্রুয়ারি নৌকাটি ভারতের জলসীমায় পৌঁছায়।

ওই নৌকায় থাকা ২৩ বছরের তরুণ শাহ আলম ২০ ফেব্রুয়ারি সকালে কক্সবাজারে থাকা তাঁর ভাইকে ফোনে জানিয়েছেন, তাঁদের নৌকা বঙ্গোপসাগরে ভাসছে। খাওয়ার মতো এক ফোঁটা পানিও আর নৌকায় অবশিষ্ট নেই। তাঁরা সবাই অলাভজনক সংস্থা ও সাংবাদিকের সাহায্য কামনা করেছেন।

যাত্রীদের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, ওই ফোনের সূত্র ধরে জিপিএসের মাধ্যমে জানা গেছে, নৌকাটি আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ভারতীয় কোস্টগার্ডের সদর দপ্তর থেকে কয়েক নটিক্যাল মাইল দূরে ভারতীয় জলসীমায় রয়েছে। একাধিক সংস্থা ঘটনাটি বাংলাদেশসহ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ভারতীয় কোস্টগার্ডকে জানিয়েছে। এর পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি ভারতের পতাকাবাহী একটি জাহাজ ওই নৌকাটিকে অতিক্রম করে। নৌকাটির দুরবস্থা জেনেও জাহাজ সেখানে দাঁড়ায়নি। ওই দিন নৌকায় থাকা পাঁচ যাত্রীর মৃত্যু হয়।

এরপর ২১ ফেব্রুয়ারি বিকেলে নৌকাটির ওপর দিয়ে ভারতের দুটি হেলিকপ্টার টহল দিতে থাকে। এর কয়েক ঘণ্টা পর ভারতীয় জাহাজটির দুই পাশে সে দেশের কোস্টগার্ডের আরও দুটি জাহাজ দেখা যায়। কিন্তু কোনো জাহাজই সাহায্য করেনি। নৌকার সঙ্গে যোগাযোগ না করেই জাহাজগুলো সেখান থেকে চলে যায়। এ সময় নৌকায় থাকা আরও তিন যাত্রীর মৃত্যু হয়। আরেক যাত্রী ক্ষুধার যন্ত্রণায় নৌকা থেকে সমুদ্রে লাফ দিলে নিখোঁজ হয়ে যান।

২১ ফেব্রুয়ারি শাহ আলম ফোনে জানিয়েছেন, নৌকার যাত্রীরা সমুদ্রে লাফিয়ে পড়ছেন। বাধ্য হয়ে সাগরের নোনা পানি খেয়ে মরে যাচ্ছেন। এ পর্যন্ত অনেকেই মারা গেছেন।

২২ ফেব্রুয়ারি বেলা তিনটার দিকে ভারতীয় কোস্টগার্ডের জাহাজ দুটি আবার নৌকার কাছে ফিরে আসে। জাহাজ থেকে নৌকার যাত্রীদের খাবার, ওষুধ ও পানি দেওয়া হয়। তবে যাত্রীদের কূলে নামার অনুমতি দেওয়া হয়নি। মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারতীয় কর্তৃপক্ষ নৌকায় খাবার সহায়তা দিয়েছিল। এরপর আর কিছু জানায়নি ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।

নৌকার যাত্রীদের জরুরি সহায়তা প্রয়োজন। তাঁরা দুই মাসের বেশি সময় ধরে সাগরে ভাসছেন। এমন পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।
ক্যাথেরিন স্টাবারফিল্ড, ইউএনএইচসিআরের এশিয়া ও প্যাসিফিক রিজিওনাল ব্যুরোর মুখপাত্র

কক্সবাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবির থেকে শাহ আলমের ভাই রবি আলম বলেন, ‘খাবার ও পানি পেয়ে নৌকার যাত্রীরা অনেক খুশি হয়েছিলেন। তবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কাউকে তীরে নামার অনুমতি দেয়নি। সেই দিনই আমার ভাইয়ের সঙ্গে ফোনে শেষ কথা হয়। এরপর আর ফোনের সংযোগ পাওয়া যায়নি।’

এ বিষয়ে ভারতীয় কোস্টগার্ডের কাছে জানতে চাওয়া হলে তারা কোনো মন্তব্য করেনি।

তবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ ও মিয়ানমার বিভাগের বিশেষ দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা কর্নেল ভি কে এস তমার বলেন, মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ভারত সাগরে ভেসে থাকা ওই নৌকায় সহযোগিতা করেছে। তবে কেন সেই সহায়তা বন্ধ করা হয়েছে, সে সম্পর্কে তিনি স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। কেন নৌকার যাত্রীদের তীরে নামতে দেওয়া হয়নি, সে সম্পর্কেও তিনি কিছু বলেননি। তিনি বলেন, ‘আমি জানি না, এই মুহূর্তে তারা এখন কোথায়।’

ইউএনএইচসিআরের এশিয়া ও প্যাসিফিক রিজিওনাল ব্যুরোর মুখপাত্র ক্যাথেরিন স্টাবারফিল্ড বলেন, নৌকার যাত্রীদের জরুরি সহায়তা প্রয়োজন। তাঁরা দুই মাসের বেশি সময় ধরে সাগরে ভাসছেন। এমন পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে নূর কায়াস ১২ বছর বয়সে তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিয়ানমারের মংডু থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

নূরের মা গুলজান কক্সবাজারে কেয়ার বাংলাদেশ পরিচালিত একটি হাসপাতালে এখন কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘মংডুতে আমাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। এ কারণে আমরা পালিয়ে এসেছি। এখানে এসে থাকা নূরের পছন্দ ছিল না। সে কিছু করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাকে কোথাও পাঠাতে পারিনি। এখান থেকে মেয়েদের তুলে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। আমার মনে হয়, এ কারণেই সে পাচারকারীদের সঙ্গে পালিয়ে যেতে চেয়েছে।’

রোহিঙ্গা উইমেন ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সদস্য রাজিয়া সুলতানা বলেন, গত কয়েক বছরে রোহিঙ্গা শিবির ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। এখানে অপহরণ, যৌন নির্যাতন ও পাচারের ঘটনা অহরহ ঘটছে। বিকেল পাঁচটার পর থেকে শিবিরে কোনো নিরাপত্তা থাকে না। সন্ধ্যার পর এখানে একদল লোক এসে মেয়েদের ওপর হামলা চালায়। মেয়েদের তুলে নিয়ে জোর করে বিয়ে করে বা কখনো ধর্ষণ করে ছেড়ে দেয়। অনেক ভুক্তভোগী পরিবার এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানিয়েছে। কিন্তু এ সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সমুদ্রে বিপদে পড়া ব্যক্তিদের উদ্ধারে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পার্শ্ববর্তী সব দেশের দায়িত্ব রয়েছে। তবে সম্প্রতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছে। মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছে, মালয়েশিয়া আর কখনো রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেবে না। চলতি মাসের শুরুর দিকে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রুল জারি করেছেন, ভারতে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জোর করে মিয়ানমারে পাঠিয়ে দিতে হবে।

এসব কারণে অন্যদের পাশাপাশি আদরের নূরকে ফিরে পাবেন কি না, মা গুলজানের সেই আশা ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসছে।