বিক্রমাসিংহের ওপর ভর করে কি গদি টেকাতে পারবেন গোতাবায়া

রনিল বিক্রমাসিংহকে প্রধানমন্ত্রীর শপথ পড়ান শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে
ছবি: বৃহস্পতিবার শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকে সরবরাহ করা

নিজের গদি টেকাতে রনিল বিক্রমাসিংহেকে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর পদে বসিয়েছেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। এর আগে পাঁচ দফায় দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা বিক্রমাসিংহে তাঁর দল থেকে শুধু তিনি নিজেই সংসদ সদস্য। ক্ষমতায় থাকাকালে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতিসহ নানা ঘটনায় সমালোচিত বিক্রমাসিংহেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে দেশটির প্রধান বিরোধী দল। শ্রীলঙ্কায় প্রভাবশালী বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের নেতারাও তাঁর বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন।

এদিকে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার পদত্যাগের দাবিতে কলম্বোয় প্রেসিডেন্ট ভবনের বাইরে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। তবে বিক্রমাসিংহের নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আর ভারত বলেছে, শ্রীলঙ্কার জনগণের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি পূরণে অবিচল থাকবে তারা।

অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে বিক্ষোভ-সহিংসতায় টালমাটাল শ্রীলঙ্কাকে রক্ষার জন্য দ্রুত নতুন সরকার গঠনের তাগাদা দিয়েছিলেন দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নন্দনাল বিরাসিংহে। না হলে দেশের অর্থনীতি একেবারে ধসে পড়বে বলে গত বুধবার সতর্ক করেছিলেন তিনি। এরপর ওই দিন সন্ধ্যায় ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির (ইউএনপি) নেতা রনিল বিক্রমাসিংহের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া। তখন থেকে গুঞ্জন শুরু হয়েছিল, বিক্রমাসিংহেই নতুন প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। এর মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান বিরোধী দল সমাজি জনা বালাভেগায়ার (এসজেবি) নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে রাজি হওয়ার কথা জানিয়ে প্রেসিডেন্টকে চিঠি পাঠান। তবে সেখানে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা কমানো এবং গোতাবায়ার প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে যাওয়ার সুনির্দিষ্ট সময়সীমা ঘোষণার শর্ত দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন

এই চিঠির কোনো জবাব দেননি গোতাবায়া রাজাপক্ষে। গতকাল সন্ধ্যায় কলম্বোয় প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে রনিল বিক্রমাসিংহেকে প্রধানমন্ত্রীর শপথ পড়ান তিনি। শপথের পর কলম্বোর ওয়ালুকরমা মন্দিরে আশীর্বাদ নিতে যান বিক্রমাসিংহে। তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকার মেনে নেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন সংসদে প্রধান বিরোধী দল এসজেবির সাধারণ সম্পাদক রণজিৎ মদ্দুমা বানদারা।

আরও পড়ুন

প্রধানমন্ত্রী পদে রনিল বিক্রমাসিংহকে মেনে না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শ্রীলঙ্কার আর্চবিশপ ম্যালকম রণজিৎও। তিনি বলেছেন, দেশের জনগণ যাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেনি, তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করা উচিত নয়। আর জ্যেষ্ঠ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ওমালপে সোবিথা বলেছেন, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে গিয়ে রনিল বিক্রমাসিংহকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছে।

৭৩ বছর বয়সী বিক্রমাসিংহেকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসিয়ে গোতাবায়া রাজাপক্ষে সংকটের আপাতসমাধান চাইলেও তা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন অনেকে। দেশটির রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাঙ্গা জয়াসুরিয়া বলেন, রনিল বিক্রমাসিংহেকে প্রধানমন্ত্রী করার মধ্য দিয়ে আগুনে ঘি ঢালা হয়েছে। এমন একজন মানুষকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছে, যাঁর প্রতি কোনো জনসমর্থন নেই। এতে সাধারণ মানুষ আরও খেপে যেতে পারে।

এই রাজনৈতিক বিভেদের মধ্যেই শ্রীলঙ্কার নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জুলি চুং গতকাল বলেছেন, শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট সমাধানে নতুন নেতৃত্বের সঙ্গে কাজ করবেন তাঁরা।

কে এই রনিল বিক্রমাসিংহে

দক্ষিণ এশিয়ার অন্য অনেক নেতার মতোই রাজনৈতিক পরিবার থেকে এসেছেন রনিল বিক্রমাসিংহে। তাঁর চাচা জুনিস জয়াবর্ধনে এক দশকের বেশি সময় শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে রাজনীতিতে আসেন তিনি। ১৯৭৭ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সে সময় প্রেসিডেন্ট ছিলেন জুনিস জয়াবর্ধনে। ওই সরকারেই সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী হন রনিল বিক্রমাসিংহে।

তামিল গেরিলাদের হাতে সাবেক প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসা নিহত হওয়ার পর ১৯৯৩ সালে প্রথমবার শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী হন বিক্রমাসিংহে। সেবার মাত্র এক বছরের কিছু বেশি সময় ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। সর্বশেষ ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী হন বিক্রমাসিংহে। সে সময় তাঁর বাল্যবন্ধু দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর অর্জুনা মাহেন্দ্রানের বিরুদ্ধে ১ কোটি ১০ লাখ ডলার অনিয়মের ঘটনা প্রকাশিত হয়। বিক্রমাসিংহে পাঁচ দফায় শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী হলেও কোনোবারই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি।

সাবেক আইনজীবী রনিল একসময় সাংবাদিকও হতে চেয়েছিলেন। একবার তিনি এএফপিকে বলেছিলেন, ১৯৭৩ সালে সংবাদপত্রের পারিবারিক ব্যবসাকে জাতীয়করণ করা না হলে সম্ভবত তিনি সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিতেন।

শঙ্কায় কলম্বো ছাড়ছেন মানুষ

বিক্ষোভ-সহিংসতার মধ্যে নিরাপত্তাশঙ্কায় কলম্বো ছাড়ছেন মানুষ। রাজধানী ছেড়ে তাঁরা গ্রামের উদ্দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। গতকাল বাসে চড়ে শত শত মানুষকে কলম্বো ছাড়তে দেখা গেছে।

গতকাল সকালে কারফিউ তোলার পরই শহর ছাড়া মানুষের ঢল নামে বাসস্টেশনে। বেলা গড়াতে মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের তথ্যমতে, সহিংসতা থেকে বাঁচতে রাজধানীর বাসিন্দাদের অনেকে তাঁদের গ্রাম বা নিজ শহরে ছুটতে শুরু করেছেন। তবে বেলা দুইটার দিকে আবারও কারফিউ জারি করা হয়।

গতকাল কলম্বোর পরিস্থিতি ছিল শান্ত। বাসস্ট্যান্ড ছাড়া রাস্তায় তেমন মানুষ ছিল না। এ ছাড়া খুব অল্পসংখ্যক মানুষকে বাইরে দেখা গেছে। আর যাঁরাও বাইরে বের হয়েছেন, তাঁরা জরুরি কেনাকাটার জন্য বেরিয়েছিলেন।

মাহিন্দার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

বিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়া মাহিন্দা রাজাপক্ষে, তাঁর ছেলে নামাল রাজাপক্ষেসহ ১৫ সহযোগীর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন দেশটির আদালত।

সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে গতকাল তাঁদের ওপর এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।