বিদেশি সহায়তা নিয়েই ডুবছে পাকিস্তান

ইতিহাসের সর্বোচ্চ দরপতন হয়েছে পাকিস্তানি রুপির। বৃহস্পতিবার দেশটিতে প্রতি ডলারের বাজারদর ২০০ রুপিতে পৌঁছেছে।
ফাইল ছবি : রয়টার্স

পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ডন পত্রিকায় একটি কলাম লিখেছেন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক জোবাইদা মোস্তাফা। তাঁর লেখনিতে পাকিস্তানের বর্তমান সমস্যা সমাধানে অর্থনীতির দিকে নজর দেওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে।

জোবাইদা মোস্তাফা লিখেছেন, বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক বক্তৃতায় পাকিস্তানে বিদেশি হস্তক্ষেপের অভিযোগ জোরেশোরে উঠছে। তবে দেশটিকে অর্থনৈতিক পতনের দিকে নিয়ে যেতে পারে এমন সমস্যাগুলো সমাধানে ঐকমত্য গঠনের বিষয়ে কোনো কথা হচ্ছে না। এভাবে দোষারোপের খেলা চলতে থাকলে আপসের সম্ভাবনা কম।

আসল কথা হচ্ছে, ভিক্ষার থালা বাড়িয়ে দেওয়ার লক্ষণ দেখতে না চাইলে আমাদের ঝুলিতে কী আছে সে বিষয়ে বুদ্ধজীবীরা কয়েক দশক ধরেই সতর্ক করে আসছেন। আজ যা ঘটছে তা বিদেশি সাহায্য গ্রহণের পুঞ্জীভূত ফলাফল।

পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ইমরান খান নিজেকে মার্কিন ষড়যন্ত্রের বলি হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। কিন্তু রাজনীতির ময়দানে নামার আগে তিনি ঠিকমতো তাঁর হোমওয়ার্ক (প্রস্তুতি) সেরে নেননি বলে মনে হয়।

পাকিস্তানের ব্যাপকভাবে প্রশংসিত পণ্ডিতদের একজন হামজা আলভি। তিনি তাঁর ‘পাকিস্তান: দ্য বার্ডেন অব ইউএস এইড’ (১৯৬২) শীর্ষক এক রচনায় উল্লেখ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সরকার প্রায়ই জোর দিয়ে বলে থাকে, তাদের সাহায্যের প্রক্রিয়াটি সরাসরি দেশ ও বিদেশে তাদের স্বার্থের উন্নতির জন্য তৈরি করা।

জোবাইদা লিখেছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্য যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে (ওয়াশিংটনের কাছে) এর মূল্য অনেক বেশি।

পাকিস্তানের ওপর এই সহায়তার প্রভাব ব্যাপক ও সরকার গঠনের সঙ্গেও এ প্রভাব জড়িয়ে আছে। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানে পরাধীন শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মার্কিন বৈশ্বিক স্বার্থ রক্ষাকারী নীতির সঙ্গে সমঝোতা নিশ্চিত করা হয়েছে। এই ধরনের শাসকদের মাধ্যমে সাহায্যদাতা যুক্তরাষ্ট্র এমন বিজ্ঞাপন তৈরি করেছে, যাতে তাদের ওপর আমাদের নির্ভরতা চিরস্থায়ী হয়। সেভাবেই আমাদের অর্থনীতিকে সাজানো হয়েছে। আমাদের সমান সুযোগ তৈরির ক্ষেত্রও কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

পাকিস্তানের আত্ম-ধ্বংসের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ১৯৫৩ সালে; যখন পাকিস্তান ওয়াশিংটনের সঙ্গে একটি সহায়তা চুক্তি করেছিল। এরপর বাগদাদ চুক্তি ও সিয়াটো চুক্তিতে তা ত্বরান্বিত হয়। পাকিস্তানকে ধীরে ধীরে হাতের মুঠোয় নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ প্রক্রিয়া থামিয়ে দেশকে নিরপেক্ষ করতে নেতারা স্নায়ুযুদ্ধের রাজনীতিতে জড়িত হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও বিভিন্ন কার্যক্রমে কারণে দেশটির ওপর নির্ভরশীলতা আরও বেড়েছে।

আশ্চর্যজনকভাবে, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিও একই ধারা অনুসরণ করেছে। পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ইমরান খান নিজেকে মার্কিন ষড়যন্ত্রের বলি হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। কিন্তু রাজনীতির ময়দানে নামার আগে তিনি ঠিকমতো তাঁর হোমওয়ার্ক (প্রস্তুতি) সেরে নেননি বলে মনে হয়। তিনি যদি আগে থেকে নিজেকে প্রস্তুত রাখতেন তবে দেশের অর্থনীতির পতন ঠেকাতে উদ্ধার পরিকল্পনা ঠিক করে রাখতেন। কোনো পরিপক্ক ও দায়িত্বশীল নেতা এ ধরনের সুযোগ হাতছাড়া করবেন না।

এখন পাকিস্তানের যে অবস্থা তাতে রাজনীতির চেয়ে অর্থনীতির দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে লন্ডনভিত্তিক জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ইউসুফ নজর তাঁর পরিকল্পনার পাঁচটি পয়েন্ট তুলে ধরেছেন। দ্য ফ্রাইডে টাইমসের একটি লেখায় তা তুলে ধরা হয়েছে। এসব পয়েন্টে বিদেশ থেকে তহবিল ধার করা বা ঋণ না নিয়ে অর্থনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধারের পথ দেখানো হয়েছে।

আরও পড়ুন

এসব প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে পেট্রলের দাম প্রতি লিটার ৩০ থেকে ৫০ রুপি বাড়িয়ে দেওয়া। এ ক্ষেত্রে কর ছাড় ও ভর্তুকি তুলে নেওয়া। জরুরি আর্থিক অবস্থা ঘোষণা দিয়ে প্রদেশগুলোতে ভূমি, সম্পদ ও কৃষি আয়ের ক্ষেত্রে কর বাড়িয়ে ১০০ বিলিয়ন রুপি সংগ্রহ করা। ১ হাজার ৬০০ সিসি বা এর ওপরের গাড়িগুলোর জন্য বিশেষ জরুরি কর পাঁচ লাখ রুপি নির্ধারণ করা। এতে ২০ বিলিয়ন রুপি আয় হবে। ৮০০ বর্গফুট বা এর চেয়ে বেশি আয়তনের আবাসিক সম্পত্তির ক্ষেত্রে বিদ্যুতের শুল্ক দ্বিগুণ করা।

অসামরিক প্রতিরক্ষা খাতে ১০০ বিলিয়ন রুপি খরচ কমানো। ফেডারেল সরকারকে ছোট করা ও অপ্রয়োজনীয় বিভাগগুলো বিলুপ্ত করা। সব জমি বরাদ্দ নিষিদ্ধ করে নিলামের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় জমি বিক্রি করা বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি বিনিয়োগ-বান্ধব পরিবেশ তৈরির জন্য বেসরকারিকরণ কর্মসূচি চালু করা।

পাকিস্তানের বর্তমান আর্থিক সমস্যার অবিলম্বে সমাধান পাওয়ার আশা করা দুরূহ। তবে পাকিস্তান ভয়ংকর পরিণতির মুখে পড়বে না এমন আশাও করেন কেউ কেউ। তাহলে কী করা উচিত? দেশে কর ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক পরিষেবা চালু করতে হবে।

আরও পড়ুন

তবে এ ক্ষেত্রে বড় বাধা ধনিক শ্রেণি। তাঁরা কর দিতে চান না। তাঁদের উচিত সামাজিক ন্যায়বিচার ও ন্যায্যতার নীতি অনুসারে কর দেওয়া। কিন্তু তাঁরা হয় কর আইনের পথ রুদ্ধ করেন বা বিদ্যমান আইনে কর দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতারণার ফাঁকফোকর খোঁজেন।

কারা এই অতি ধনী শ্রেণি? ইউসুফ নজরের চোখে তাঁরা হচ্ছেন, দেশের করপোরেট খাত, জমির মালিক, বড় বড় সম্পদশালী ও বড় কৃষিবিদ। তাঁদের সবার সম্পদের বিষয়টি তালিকাবদ্ধ করতে হবে। এ কাজটির বড় অংশ ইতিমধ্যে করা হয়ে গেছে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের অধীনে পাকিস্তানে সাব্বার জাহিদিকে এফবিআরের (কেন্দ্রীয় রাজস্ব বোর্ড) চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁর কাজের বড় অংশ ছিল দেশের বড় বড় ব্যাংক হিসাবধারীদের করের আওতায় আনা। কিন্তু করপোরেট খাত থেকে চাপ বাড়ায় ও ইমরান ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় টিকতে পারেননি জাহিদি।

পাকিস্তানে সমস্যা থেকে উত্তরণে বড় প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার নৈতিক সাহস। প্রশ্ন হচ্ছে, একটি দেশ কি সত্যিকারের স্বাধীন হতে পারে, যদি দেশের অতি-ধনীরা কর না দেন ও দরিদ্রদের খাওয়াতে হয় বিদেশ থেকে সাহায্য এনে?

অনুবাদ: মো. মিন্টু হোসেন