ভয়াবহ সংকটের ঝুঁকিতে আফগানিস্তান

আফগানিস্তানে কাবুলের উপকণ্ঠে আশ্রয়শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন অনেকে
ছবি : এএফপি

আফগানিস্তান অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার ভাঙনের মুখোমুখি হচ্ছে, যা দেশটিকে মানবিক বিপর্যয়ের ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ফরেন পলিসি প্রধান জোসেফ বোরেল গতকাল রোববার এ কথা বলেছেন।

জোসেফ বোরেল বলেন, আফগানিস্তানে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য তালেবানকে শর্ত মেনে চলতে হবে, যাতে তারা আরও বেশি আন্তর্জাতিক সহায়তা পেতে পারে। খবর রয়টার্সের।


এক ব্লগ পোস্টে বোরেল বলেছেন, আফগানিস্তান একটি গুরুতর মানবিক সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে এবং আর্থসামাজিক পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে, যা আফগানসহ ওই অঞ্চল এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক।

গত আগস্টে তালেবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে দেশটিতে খাবার দাম ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে। এ ছাড়া ৯০০ কোটি মার্কিন ডলার আফগান রিজার্ভ স্থগিত হয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি আফগান জনগণকে সাহায্য করতে এগিয়ে না আসে, তাহলে দেশটিতে মানবিক সংকট দেখা দিতে পারে।
ইমরান খান, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী

বোরেলের তথ্য অনুযায়ী, আফগান ব্যাংকিং ব্যবস্থা অনেকাংশে অচল, মানুষ অর্থ উত্তোলন করতে পারছে না। বৈদেশিক সাহায্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মুখে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে এবং শীতের মৌসুম আসতে থাকায় সেখানকার মানবিক পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।

আফগানিস্তানে তালেবান নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭ দেশ সেখানে মানবিক সহায়তা জোরদার করেছে। তবে সেখানে উন্নয়ন সহায়তা স্থগিত রয়েছে।

নতুন করে বোমা হমলার আশঙ্কা ও মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের শেষ সময় ঘনিয়ে আসায় রাস্তায় রাস্তায় তালেবানের বিশেষ যোদ্ধা ইউনিটের সতর্ক প্রহরা। রোববার কাবুলের রাজপথে
ছবি: এএফপি।

বোরেল বলেন, নতুন আফগান কর্তৃপক্ষের আচরণের ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিক্রিয়া নির্ভর করছে। সম্পর্ক আবার ঠিক করতে হলে মানবাধিকারসহ বিভিন্ন শর্ত পূরণ করতে হবে।

গত সপ্তাহে কাতারের রাজধানী দোহায় কাতারের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেন বোরেল। ওই বৈঠকে তালেবান প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, তালেবানের সঙ্গে কাতারের যোগাযোগের লক্ষ্য ছিল তাদের আচরণ ঠিক করা। তিনি দোহাকে তার প্রভাব খাটিয়ে আফগানিস্তানের বিপর্যয় ঠেকানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতে আহ্বান জানান।

শিশুরা মারা যাচ্ছে অপুষ্টিতে

বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, আফগানিস্তানের স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো দাবি করছে, আফগানিস্তানে ক্ষুধায় শিশুরা মারা যাচ্ছে। সতর্ক করে বলা হচ্ছে, বছরের শেষ নাগাদ আফগানিস্তানে ১০ লাখের বেশি শিশু অপুষ্টির শিকার হতে পারে। এতে তাদের জীবন হুমকির মধ্যে পড়ে যেতে পারে।

ঘরে খাবার নেই, খাদ্যের সন্ধানে আবর্জনার স্তূপে ঘাঁটাঘাঁটি করছে আফগান শিশুরা। গত মঙ্গলবার কাবুল বিমানবন্দরের কাছে।
ছবি: এএফপি

দেশটির নানগারহর প্রদেশের হাসপাতালে গত ছয় মাসে ১৭ শিশু অপুষ্টির শিকার হয়ে মারা গেছে। প্রাদেশিক জনস্বাস্থ্য পরিচালক মোল্লা মোহাম্মদ আহমাদি এ তথ্য জানান। জাতিসংঘের শিশু সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেছেন, অনেক শিশুকে আফগান পরিস্থিতির চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে।

তালেবান সমর্থকের মিছিল

আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের উত্তরে মিছিল করেছেন তালেবানের প্রায় এক হাজার সমর্থক। রোববার সকালে রাজধানীর উপকণ্ঠে খোদামান শহরে একটি মাঠে শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। তালেবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর কাবুলে এই প্রথম এমন কোনো সমাবেশ করলেন সংগঠনটির সমর্থকেরা।

আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের উত্তরে র‌্যালি করেছেন তালেবানের প্রায় এক হাজার সমর্থক
ফাইল ছবি: এএফপি

বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়, শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন শুধু পুরুষেরা। ছিল কিশোরেরাও। তবে দেখা যায়নি কোনো নারীকে। সকাল থেকেই তাঁরা খোদামান শহরে সমাবেশস্থলে উপস্থিত হতে থাকেন। এ সময় সেখানে তালেবানের জয় উপলক্ষে গান বাজাতে দেখা যায়। মিছিলে অনেক সমর্থকই হাজির হয়েছিলেন নানা ধরনের পোস্টার নিয়ে। অনেকের মাথায় আবার বাঁধা ছিল তালেবানের লাল-সাদা ব্যান্ড।

মিছিলের মূল অনুষ্ঠান শুরুর আগে কুচকাওয়াজ করেন তালেবান যোদ্ধারা। এ সময় তাঁদের হাতে ছিল পতাকা এবং বন্দুক, রকেট লঞ্চারসহ বিভিন্ন অস্ত্র। ভারী অস্ত্র নিয়ে ঘটনাস্থলে পাহারায় ছিলেন অনেক তালেবান সদস্য। আজকের সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন তালেবানের শীর্ষস্থানীয় নেতারাও। সমর্থকদের উদ্দেশে তাঁরা বক্তব্য দেন। গত বৃহস্পতিবারও কাবুলের পূর্বাঞ্চলে অধিকারের দাবিতে সমাবেশ করেছেন নারীরা।

যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতির আশা

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে ‘আজ না হোক কাল’ তালেবানের নেতৃত্বাধীন আফগান সরকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে। বার্তা সংস্থা এএনআইয়ের প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। ইমরান খানের তুরস্কের টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন। পাকিস্তানের জিও টিভির প্রতিবেদনেও বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান
ফাইল ছবি: রয়টার্স

পাকিস্তান যদি একতরফাভাবে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়, তাহলে তা কোনো কাজে আসবে না বলে মন্তব্য করেন ইমরান খান।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, চীন ও রাশিয়ার উচিত অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া।

ইমরান খান আরও বলেন, বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তান তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে। আলোচনার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আফগান সরকারকে সহায়তা প্রদানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আবার আহ্বান জানিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশটি অনেকাংশে বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল।

ইমরান খান বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি আফগান জনগণকে সাহায্য করতে এগিয়ে না আসে, তাহলে দেশটিতে মানবিক সংকট দেখা দিতে পারে।