যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বন্দ্বের জেরে ক্ষেপণাস্ত্রে সমৃদ্ধ হচ্ছে এশিয়ার দেশগুলো

চীনে সামরিক কুচকাওয়াজে ডিএফ-২৬ ক্ষেপণাস্ত্রের প্রদর্শনী।
ফাইল ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বিশ্বের দুই পরাশক্তি। দেশ দুটির মধ্যে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা চলছে। যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যকার রেষারেষির প্রভাব পড়ছে এশিয়ায়। এশিয়ার ছোট দেশগুলো এখন ভয়ানক অস্ত্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। তারা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সমৃদ্ধ করছে। এ ক্ষেত্রে হয় তারা অন্যের কাছ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র কিনছে, নয়তো নিজেরাই তা উৎপাদন করছে। এশিয়ায় চীনের আধিপত্যের জেরে নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই তারা এমনটা করছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমানোর দিকটিও রয়েছে। আজ মঙ্গলবার বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক বিশ্লেষণে এমনটাই বলা হয়।

রয়টার্স বলছে, চীন ব্যাপকভাবে ডিএফ-২৬ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে। বহুমুখী এই অস্ত্র চার হাজার কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। অন্যদিকে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনকে টেক্কা দিতে যুক্তরাষ্ট্রও নতুন অস্ত্র তৈরি করছে।

২০২১ সালের অপ্রকাশিত কিছু সামরিক নথির বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসেফিক কমান্ড এ অঞ্চলে নতুন অত্যাধুনিক দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের পরিকল্পনা করছে, যার আওতায় চীন ও রাশিয়াও চলে আসবে।

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর মধ্যে দূরপাল্লার হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। এগুলো এলআরএইচডব্লিউ নামে পরিচিত। শব্দের চেয়ে ৫ গুণ বেশি গতিসম্পন্ন এই ক্ষেপণাস্ত্র ২ হাজার ৭৭৫ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসেফিক কমান্ডের এক মুখপাত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, এই ক্ষেপণাস্ত্র কোথায় মোতায়েন করা হবে, সে বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী দেশগুলো এই অস্ত্র মোতায়েনের বিষয়ে দ্বিধায় আছে। তবে এলআরএইচডব্লিউ যদি প্রশান্ত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের গুয়াম দ্বীপে স্থাপন করা হয়, তাহলে তা চীনের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানতে পারবে না।

সূত্র বলছে, জাপানে ৫৪ হাজারের বেশি মার্কিন সেনা রয়েছে। টোকিও যদি ওয়াশিংটনকে তার নতুন ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনের অনুমতি দেয়, তাহলে হয়তো যুক্তরাষ্ট্রকে জাপান থেকে কিছু সেনা ফিরিয়ে নিতে হবে।

তবে যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনের অনুমতি দিলে জাপানকে চীনের কড়া প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়তে হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ক্ষমতার প্রতিযোগিতার এমন প্রেক্ষাপটে এশিয়ার ছোট দেশগুলো নিজেদের নিরাপত্তার খাতিরে নিজস্ব অস্ত্রের ভান্ডার সমৃদ্ধ করছে।

সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া ঘোষণা দিয়েছে, তারা আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণে আগামী ২০ বছরে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করবে।

জাপানও ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণের কাজে লাখ লাখ ডলার ব্যয় করছে। তারা নতুন একটি ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে। এই ক্ষেপণাস্ত্র এক হাজার কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারবে।

যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগীদের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া ক্ষেপণাস্ত্র সমৃদ্ধকরণে বেশ এগিয়ে রয়েছে। তারা হুনমু-৪ নামের ক্ষেপণাস্ত্রের উৎপাদন বাড়িয়েছে। এই ক্ষেপণাস্ত্রের ৮০০ কিলোমিটার দূরে আঘাত হানার সক্ষমতা রয়েছে। অর্থাৎ, এই ক্ষেপণাস্ত্র সহজেই চীনে আঘাত হানতে পারবে।

দক্ষিণ কোরিয়া তার প্রতিবেশী উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিযোগিতা করছে। সম্প্রতি উত্তর কোরিয়া নিজেদের কেএন-২৩ ক্ষেপণাস্ত্রের আধুনিক সংস্করণের পরীক্ষা চালিয়েছে। এই ক্ষেপণাস্ত্র দক্ষিণ কোরিয়ার হুনমু-৪-এর সঙ্গে পাল্লা দিতেই নির্মাণ করা হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

চীনের সঙ্গে তাইওয়ানের উত্তেজনা সাম্প্রতিক সময়ে আরও বেড়েছে। তারা ব্যাপকভাবে অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করছে বলে জানা গেছে। তাইওয়ান প্রকাশ্যে ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পের ঘোষণা দেয়নি। তবে তারা নানা ধরনের ক্রুজ মিসাইল বানাচ্ছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এগুলো চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে আঘাত হানতে পারবে বলে বলা হচ্ছে। এ ছাড়া গত ডিসেম্বরে তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকেই স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কেনার অনুমোদন পেয়েছে।

একটি কূটনৈতিক সূত্রের ভাষ্য, এত দিন তাইওয়ানের সশস্ত্র বাহিনীর মূল লক্ষ্য ছিল চীনের আগ্রাসন থেকে নিজেদের রক্ষা করা। কিন্তু এখন তাদের মধ্যে আক্রমণাত্মক মনোভাব লক্ষ করা যাচ্ছে।

বেইজিংভিত্তিক কৌশলগত নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ঝাও তং বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী দেশগুলোর দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার সক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আঞ্চলিক সংঘাতে তাদের অংশগ্রহণের আশঙ্কাও বাড়বে।

বিশ্লেষক, কূটনীতিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের ধারণা, চলতি দশক শেষ হওয়ার আগেই এশিয়া আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় মারাত্মক সব ক্ষেপণাস্ত্রে ভরে উঠবে।

প্যাসেফিক ফোরামের প্রেসিডেন্ট ডেভিড সান্তোরো বলেন, এশিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্রের চিত্র খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। দীর্ঘ মেয়াদে তার প্রভাব কী হবে, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে এর ফলে এই অঞ্চলে উত্তেজনায় ভারসাম্য ও শান্তিরক্ষার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

প্যাসেফিক ফোরামের প্রেসিডেন্ট বলেন, ক্ষেপণাস্ত্রের প্রসার এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সন্দেহ, উত্তেজনা ও অস্ত্রের প্রতিযোগিতা বাড়াতে পারে। এতে সংকট দেখা দিতে পারে। এমনকি যুদ্ধও বেধে যেতে পারে।