রাজনীতি ভালো হলে করোনা মহামারি বিদায় হবে

প্রতীকী ছবি
ছবি: রয়টার্স

করোনার নতুন ধরন অমিক্রন শনাক্ত হওয়ার পর পরিস্থিতি মোকাবিলায় আবারও সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার পথ বেছে নিয়েছে বিশ্ব। নতুন করে জারি করা হয়েছে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার মতো কঠোর সব বিধিনিষেধ। বিজ্ঞানীরা বারবারই বলে আসছেন, করোনাভাইরাসের রূপান্তর চলতেই থাকবে। পর্যায়ক্রমে নতুন নতুন ধরন শনাক্ত হতেই থাকবে। এরপরও বিশ্বকে নিষেধাজ্ঞার বিকল্প উপায় নিয়ে ভাবতে দেখা যাচ্ছে না। এমন অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার মতো কঠোর বিধিনিষেধগুলো কি কখনোই শেষ হওয়ার নয়? আল–জাজিরার বিশেষ এক প্রতিবেদনে মহামারি পরিস্থিতি অনন্তকাল ধরে চলার নেপথ্যের কারণ শনাক্তের চেষ্টা করা হয়েছে। ভাইরাসবিদ্যা, রোগতত্ত্ব, চিকিৎসানীতি ও অর্থনীতিসংক্রান্ত বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ আল–জাজিরাকে বলছেন, মহামারি অবসানের বিষয়টি চূড়ান্ত অর্থে রাজনৈতিক ও সামাজিক ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে।

আল–জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্প্রতি আফ্রিকা অঞ্চলে করোনার নতুন ধরন অমিক্রন শনাক্ত হওয়ার পর বিভিন্ন দেশ সেখানে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। গত সপ্তাহে জাপান অস্থায়ী বাসিন্দাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। দক্ষ অভিবাসী ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য আবারও সীমান্ত খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছে অস্ট্রেলিয়া। হংকং ৩৬টি দেশ থেকে অস্থায়ী বাসিন্দাদের ভ্রমণ নিষিদ্ধ করেছে। বিদেশফেরত শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে ২১ দিনের হোটেল কোয়ারেন্টিন চালু রেখেছে তারা। মহামারিজুড়েই মেইনল্যান্ড চায়নার সীমান্তে কঠোর কিছু বিধিনিষেধ জারি রয়েছে। শুধু নিজস্ব নাগরিক ও স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া ব্যক্তিরা সেখানে প্রবেশ করতে পারেন। মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে কিছু কোয়ারেন্টিনমুক্ত ভ্রমণ লেন চালু করার কথা থাকলেও তা বিলম্বিত করা হচ্ছে। সব ভ্রমণকারীর জন্য ১০ দিনের কোয়ারেন্টিন বিধি পুনর্বহাল করেছে দক্ষিণ কোরিয়া।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে প্রচুরসংখ্যক মানুষ টিকা নেওয়ার পরও এসব দেশ ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন বিধিনিষেধের পথকেই বেছে নিয়েছে। আর এর মধ্য দিয়ে ধারণা করা যায়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধনকারী এসব বিধিনিষেধ চক্র কখনোই শেষ হওয়ার নয়। এ চক্রের সমাপ্তি টানতে চাইলে কর্তৃপক্ষকে তাদের ধারণা পরিবর্তন করতে হবে এবং ভাইরাসের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলা শিখতে হবে।

অমিক্রন শনাক্ত হওয়ার আগেও এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের একটি বড় অংশে ভ্রমণকারীদের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল। ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসের তুলনায় চলতি বছরের অক্টোবর মাসে প্রায় ৯৩ শতাংশ বিমান চলাচল কমে গেছে। এভাবে ঢালাও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার সমালোচনা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সংস্থাটি বলছে, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ভাইরাসের বিস্তার যতখানি না ঠেকানো যায়, তার তুলনায় এটি জীবন ও জীবিকাকে অনেক বেশি কঠিন করে তোলে।

কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ইয়ান ম্যাকে আল–জাজিরাকে বলেন, মহামারিগুলো প্রকৃতিগতভাবে রাজনৈতিক। প্রতিটি দেশ ভিন্নভাবে পদক্ষেপ নিলে আদৌ স্বাভাবিক জীবনে ফেরা সম্ভব কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। তিনি মনে করেন, পরবর্তী সময়ে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা নিয়ে ভাবনায় নিবিষ্ট না থেকে কীভাবে এর সমাপ্তি টানা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে।

অক্সফোর্ড ইউয়েহিরো সেন্টার ফর প্র্যাকটিক্যাল এথিকসের জ্যেষ্ঠ গবেষক আলবার্টো জিউবিলিনি মনে করেন, ‘একটানা জরুরি পরিস্থিতি’ চালু থাকার ধারণা থেকে সরে আসতে হবে। তাঁর মতে, বিধিনিষেধ অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা যতখানি না প্রভাব ফেলছে, তার চেয়েও অনেক বেশি প্রভাব ফেলছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বদ্ধমূল চিন্তাধারা।

আলবার্টো জিউবিলিনি আল–জাজিরাকে বলেন, ‘ভাইরাস যখন সামলে নেওয়ার মতো অবস্থায় চলে আসে এবং মানুষ এর সঙ্গে মানিয়ে নিতে শেখে, তখন মহামারি শেষ হয়ে যায়। তবে এ ক্ষেত্রে ভাইরাসটি কেমন আচরণ করছে, তার চেয়ে জরুরি প্রশ্ন হলো আমরা কী ব্যবস্থা নিচ্ছি তা। আমরা নির্দিষ্ট কিছু জিনিসকে বৈজ্ঞানিক ইস্যু ভেবে ভুল করছি। মহামারি অবসানের বিষয়টি রাজনৈতিক আলোচনার সঙ্গে জড়িত। চূড়ান্ত অর্থনৈতিক একটি ইস্যু এটি। যে ভাইরাসটি চিরদিনের জন্য আমাদের মধ্যে থেকে যাচ্ছে, তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে আমরা যখন আচরণে পরিবর্তন আনতে পারব, তখনই মহামারির অবসান হবে।’

জিউবিলিনি আক্ষেপ করে আরও বলেন, ২০২০ সালের মার্চে জরুরি পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে লকডাউন জারি করা শুরু করেছিল বিভিন্ন দেশ। তবে এত দিন পরও সে ‘জরুরি পরিস্থিতি’র ধারণা থেকে সরে আসতে পারেনি দেশগুলো।
হংকংয়ের এইচকেইউ-প্যাস্টিউর রিসার্চ পোলের সহপরিচালক রবার্টো ব্রুজোনে আল–জাজিরাকে বলেন, অমিক্রন নিয়ে যতটুকু তথ্য পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতে বিশ্বের দেশগুলো যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তা অন্যায্য। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ সময় ধরে আমি দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনার কথা বলে আসছি। বারবারই বলে আসছি, নতুন ভাইরাসের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে চলা শিখতে হবে আমাদের।’

ব্রুজোনে আশা করেন, বিশ্ব এমন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে না, যেখানে দেশগুলোর মধ্যকার সীমান্ত ও যোগাযোগব্যবস্থা স্থায়ীভাবে সীমিত হয়ে পড়বে।
মেলবোর্নের ডায়াকিন বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও রোগ তাত্ত্বিক ক্যাথেরিন বেনেট বলেন, জনমতের ক্ষেত্রে বিভক্তি ও রাজনৈতিক হিসাব–নিকাশের কারণে ‘কখনোই শেষ না হওয়ার এ চক্র’ সৃষ্টি হয়েছে। তিনি মনে করেন, ভাইরাসের রূপান্তর হচ্ছে বলে আভাস পাওয়ার পর অভ্যন্তরীণভাবে জননিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাগুলো জোরালো করা যেতে পারে।