রাজবন্দী থেকে রাষ্ট্রক্ষমতায়, তারপর...

২০১০ সালে গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি পা্ওয়ার পর নিজবাড়িতে সমর্থকদের শুভেচ্ছায় সিক্ত হন সু চিএএফপির ফাইল ছবি

মিয়ানমারের কার্যত নেতা অং সান সু চি ও তাঁর ক্ষমতাসীন দল এনএলডির কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতাকে আজ সোমবার গ্রেপ্তার করেছে সেনাবাহিনী। পরে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সু চি সরকারকে হটানোর বিষয়টি নিশ্চিত করে তারা। গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জালিয়াতি করে এনএলডি ক্ষমতায় এসেছে—এমন অভিযোগ করার পর শুরু হয় দুপক্ষের মধ্যে টানটান উত্তেজনা। এরই ধারাবাহিকতায় গত সপ্তাহে সরকারের বিরুদ্ধে ‘ব্যবস্থা গ্রহণের’ হুমকি দেয় সেনাবাহিনী।

২০১১ সালে গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থায় উত্তরণের আগপর্যন্ত মিয়ানমারের ক্ষমতায় ছিল সেনাবাহিনী। আজ সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশটি প্রায় এক দশক পর আবারও আগের অবস্থায় ফেরত গেল। সু চির জীবন ও কর্ম, সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর টানাপোড়েন, প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জিতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আরোহণ, দ্বিতীয়বার নির্বাচনে জয়, আকস্মিক ক্ষমতা হারানো—নানা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে রয়টার্সের প্রতিবেদন:

১৯ জুন ১৯৪৫: মিয়ানমারের স্বাধীনতার নায়ক জেনারেল অং সানের মেয়ে অং সান সু চির জন্মগ্রহণ। তাঁর দুই বছর বয়সের সময় খুন হন বাবা।

১৯৮৮: মায়ের দেখাশোনায় মিয়ানমারের ফেরত আসেন সু চি। কয়েক দশক ধরে চলা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলেন।

১৯৮৯: আন্দোলন গুঁড়িয়ে দেয় সেনাবাহিনী। নিহত হয় কয়েক হাজার মানুষ। গৃহবন্দী হন সু চি।

১৯৯১: ইয়াঙ্গুনে নিজ বাড়িতে বন্দী থাকাকালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয় সু চির।

১৯৯৫: বন্দিজীবন থেকে মুক্তি। নিয়মিত বাড়ির সামনে বড় জমায়েতে বক্তব্য প্রদান।

১৯৯৯: সু চির স্বামী ও যুক্তরাজ্যের নাগরিক মাইকেল অ্যারিস ক্যানসারে মারা যান। জান্তা সরকার দেশে ফেরা আটকে দিতে পারে—এমন আশঙ্কায় মৃত স্বামীকে দেখতে মিয়ানমার ছেড়ে যাননি তিনি।

সামরিক শাসন থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের পর মিয়ানমারের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসন

২০০০: সু চি ১৯ মাসের জন্য আবার গ্রেপ্তার হন।

২০০৩: সু চি ও তাঁর সমর্থকদের ওপর জান্তা সমর্থকদের হামলা। কয়েকজন নিহত।

২০০৭: জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের নেতৃত্বে জান্তা সরকারবিরোধী আন্দোলন। পুলিশপরিবেষ্টিত অবস্থায় নিজ বাড়ির সামনে সন্ন্যাসীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ সু চির। বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠলে সেনাবাহিনীর ত্বরিত পদক্ষেপে পণ্ড আন্দোলন।

২০১০: সাধারণ নির্বাচনে সামরিক বাহিনীর তৈরি রাজনৈতিক দলের বিপুল ভোটে বিজয়। সু চির দল এনএলডির নির্বাচন বর্জন। সমালোচনার মুখে সাবেক জেনারেল থেইন সেইনের নেতৃত্বে আধা বেসামরিক সরকার গঠন। সু চির চলাচলের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার।

২০১২: বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেন থেইন সেইন। মুক্ত হন শত শত রাজনৈতিক বন্দী। হাতে নেওয়া হয় ধারাবাহিক সংস্কার কর্মসূচি। এর পুরস্কার হিসেবে মিয়ানমারের ওপর থেকে তুলে নেওয়া হয় পশ্চিমা দেশগুলোর অধিকাংশ নিষেধাজ্ঞা।

এপ্রিল ২০১২: উপনির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত সু চির। ভোটে ৪৪ সংসদীয় আসনের ৪৩টিতে এনএলডির জয়।

১৩ নভেম্বর ২০১৮ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতাকে উসকে দেওয়ার অভিযোগে সু চিকে দেওয়া সবচেয়ে সম্মানজনক মানবাধিকার পুরস্কার প্রত্যাহার করে নেয় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

মে ২০১২: নেপিডোয় পার্লামেন্টে নিজ আসনে বসেন সু চি।

জুন ২০১২: রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম ও বৌদ্ধদের সংঘর্ষ। নিহত অন্তত ৮০ জন। পুড়িয়ে দেওয়া হয় হাজারো বাড়িঘর। ইউরোপে পাঁচ দেশ সফরে যান সু চি।

নভেম্বর ২০১৫: সাধারণ নির্বাচনে এনএলডির ভূমিধস জয়। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় সু চির দল। স্টেট কাউন্সেলরের বিশেষ ভূমিকা পান সু চি।

অক্টোবর ২০১৬: উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইনে তিন পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা। নয় পুলিশ সদস্য নিহত। হামলার জন্য রোহিঙ্গা মুসলিমদের দায়ী করে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনী। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ।

২৫ আগস্ট ২০১৭: রাখাইনে কয়েকটি পুলিশ ফাঁড়িতে আবার হামলা। শুরু হয় রোহিঙ্গাদের ওপর নতুন করে জ্বালাও-পোড়াও, খুন, ধর্ষণ। প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় ৭ লাখ ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা।

সেপ্টেম্বর ২০১৭: রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অব্যাহত নির্যাতন-নিপীড়নে নীরব ভূমিকায় সু চির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সমালোচনার ঢল।

২০১১ সালে গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থায় উত্তরণের আগপর্যন্ত মিয়ানমারের ক্ষমতায় ছিল সেনাবাহিনী। আজ সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশটি প্রায় এক দশক পর আবারও আগের অবস্থায় ফেরত গেল।

১৩ নভেম্বর ২০১৮: রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতাকে উসকে দেওয়ার অভিযোগে সু চিকে দেওয়া সবচেয়ে সম্মানজনক মানবাধিকার পুরস্কার প্রত্যাহার করে নেয় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

২৯ জানুয়ারি ২০১৯: এনএলডির পক্ষ থেকে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব। সংসদে সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরকারদলীয় আইনপ্রণেতাদের দ্বন্দ্ব।

ডিসেম্বর ২০১৯: রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার অভিযোগে হেগে আন্তর্জাতিক আদালতে গাম্বিয়ার করা মামলা নিয়ে শুনানি। আদালতে উপস্থিত থেকে গণহত্যার এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন সু চি।

২৩ জানুয়ারি ২০২০: গণহত্যার শিকার হওয়া থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে রক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে মিয়ানমারকে নির্দেশ আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের।

১৩ নভেম্বর ২০২০: পার্লামেন্ট নির্বাচনে জয়ের পর জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠনে আগ্রহ প্রকাশ এনএলডির। তবে প্রধান বিরোধী দল সেনাসমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) অনিয়মের অভিযোগ তুলে পুনরায় নির্বাচন দেওয়ার দাবি।

২৬ জানুয়ারি ২০২১: নির্বাচনী বিতর্কের অবসান না হলে ‘ব্যবস্থা গ্রহণের’ হুমকি দেন সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জ মিন তুন। ভোটার তালিকায় অসামঞ্জস্য থাকার অভিযোগ তুলে এ নিয়ে তদন্ত করার জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান।

২৮ জানুয়ারি ২০২১: ভোট জালিয়াতির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে কমিশন জানায়, নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়—এমন বড় ধরনের কোনো ত্রুটি হয়নি।

১ ফেব্রুয়ারি ২০২১: স্টেট কাউন্সেলর সু চি, প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ত ও এনএলডির অন্য জ্যেষ্ঠ নেতাদের গ্রেপ্তার করে সেনাবাহিনী। বলেছে, এটি নির্বাচনে ‘জালিয়াতির জবাব’।