সুনামির ১০ বছর পরও সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারেনি জাপান

জাপানে ভূমিকম্প ও সুনামিতে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে পায়রা আকৃতির বেলুন উড়িয়ে দেওয়া হয়। আজ বৃহস্পতিবার মিয়াগির নাতোরি এলাকায়
ছবি: এএফপি

১০ বছর আগে নজিরবিহীন এক দুর্যোগে ভীষণভাবে ধাক্কা খেয়েছিল জাপান। প্রচণ্ড শক্তিশালী ভূমিকম্পের পর ধেয়ে আসা সুনামি (সামুদ্রিক ঢেউ) দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিস্তৃত এলাকাই শুধু প্লাবিত করেনি, ক্ষতিগ্রস্ত করে ফুকুশিমা জেলায় অবস্থিত একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকেও।

সুনামির আঘাতে পারমাণবিক চুল্লি শীতলীকরণে ব্যবহৃত পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে বিস্ফোরণ ঘটে ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রে। এতে ছড়িয়ে পড়ে তেজস্ক্রিয়তা। এর ঠিক পরপর ফুকুশিমার ৮০ হাজারের বেশি মানুষকে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয় জাপান সরকার। আতঙ্কজনক পরিস্থিতিতে রাজধানী টোকিওর মানুষও নিরাপদ বোধ করতে পারেনি।

ভূমিকম্প ও সুনামির আঘাতে নিহত মানুষের সংখ্যা ১৯ হাজার ছাড়িয়ে যায়। জাপানের ইতিহাসে যা ছিল সত্যিকার অর্থে বড় একটি বিপর্যয়। এক দশকে দেশটির পক্ষে এই দুর্যোগের আঘাত কাটিয়ে ওঠা অনেকাংশে সম্ভব হলেও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার লোকজনকে এখনো বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

দুর্যোগের পর থেকে পুনর্নির্মাণ ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য বিশাল অঙ্কের অর্থ জাপান খরচ করেছে। এই অর্থে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তিনটি জেলা—ইওয়াতে, মিয়াগি ও ফুকুশিমায় ভেঙে পড়া অনেক অবকাঠামো আবার গড়ে উঠলেও সামাজিকভাবে মানুষ হয়ে পড়েছে অনেকটাই নিঃসঙ্গ ও বিচ্ছিন্ন। বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্ত তিন জেলার যুবসমাজের বড় একটি অংশ অপেক্ষাকৃত বড় শহরগুলোতে সরে যাওয়ায় ওই সব জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল অনেকটাই যেন হয়ে উঠেছে বৃদ্ধদের বসবাসের বিরানভূমি।

সরকারের সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়, গত এক দশকে ফুকুশিমায় জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। যদিও জাপানে সার্বিকভাবেই জনসংখ্যা কমছে। একই সময় জাতীয় পর্যায়ে জনসংখ্যা হ্রাসের গড় হার ছিল ২ শতাংশ।

এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে নানা রকম সহায়ক কর্মসূচি হাতে নেওয়ার পরও ক্ষতিগ্রস্ত অনেক এলাকার অর্থনীতি এখনো আগের অবস্থায় ফিরতে পারছে না। কিছু ক্ষেত্রে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে আবার যাত্রা শুরু করলেও সার্বিকভাবে তা ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এর পেছনে নেতিবাচক কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, ওই তিন জেলা কৃষি ও মৎস্যশিল্পের জন্য পরিচিত। সেখানকার কৃষিপণ্যের বড় একটি অংশ বিদেশে রপ্তানি করা হতো। তোহোকু অঞ্চল নামে পরিচিত ওই এলাকার কৃষিপণ্যের চাহিদায় সুনামি পূর্ববর্তী সময়ে ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করা গেলেও পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুর্ঘটনার পর অনেক দেশ তেজস্ক্রিয় দূষণের আশঙ্কায় এখানকার কৃষিপণ্য আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। অধিকাংশ দেশ ইতিমধ্যে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেও প্রতিবেশীরা এখনো তা বহাল রেখেছে। জাপানের কৃষিপণ্যের বড় একটি অংশ প্রতিবেশী দেশগুলোতে যায়। ফলে সেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারছেন না তোহোকু অঞ্চলের কৃষি ও মৎস্যজীবীরা।

জাপান সরকার ও সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎ প্রতিষ্ঠান ফুকুশিমা বিদ্যুৎকেন্দ্রের তেজস্ক্রিয়তা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হলেও কিছু সমস্যার সমাধান এখনো করতে পারেনি। জাপানের মোট সক্রিয় ৫৪টি পরমাণু চুল্লির অধিকাংশ দুর্ঘটনার পর থেকে বন্ধ রয়েছে। হাতে গোনা কয়েকটি পুনরায় চালু করা সম্ভব হলেও অন্যগুলোর বেলায় সরকার চাইলেও অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগণের বিরোধিতায় আবার সচল করা যাচ্ছে না। দুর্যোগের আগে জাপানের মোট বিদ্যুৎ চাহিদার প্রায় ৩০ শতাংশ আসছিল পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। হঠাৎ সেগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জ্বালানির বিকল্প উৎস হিসেবে সরকার আবার জীবাশ্ম জ্বালানিতে ফিরে গেছে। গত এক দশকে সরকার সৌর, বায়ু ও পরিবেশবান্ধব অন্যান্য জ্বালানির উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা করে গেলেও সেখানে অগ্রগতি খুবই ধীর।

এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত তিনটি জেলার ভুক্তভোগীদের অনেকেই ১০ বছর পরও স্বজন হারানোর বেদনা থেকে বের হতে পারেননি। বিশেষ করে মৃত ব্যক্তিদের তালিকায় থাকা যে কয়েক শ লোকের লাশের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি, তাঁদের স্বজনদের বেলায় সেই শোক আরও গভীরতর। তাঁদের কেউ কেউ এখনো মনে আশা জিইয়ে রেখেছেন যে হারিয়ে যাওয়া নিকটজন হয়তো হঠাৎ একদিন উপস্থিত হয়ে নিজেদের বেঁচে থাকার কথা জানাবেন।