বিশ্বের গভীরতম ১০ হ্রদ, কোন কোন দেশে অবস্থান

ভৌগোলিক দুর্যোগে ভূমিতে সৃষ্ট ফাটল, হিমবাহ গলে যাওয়া এলাকা, পাহাড়ি অঞ্চল কিংবা নদী অববাহিকায় সাধারণত হ্রদ সৃষ্টি হয়ে থাকে। ভূতাত্ত্বিক যুগ বিভাজনের দিক থেকে বিবেচনা করলে সব হ্রদ ক্ষণস্থায়ী। পলি দিয়ে ভরাট হওয়াসহ নানা কারণে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হ্রদের পানি শুকিয়ে যেতে পারে। তবে সক্রিয় কিছু প্রাকৃতিক কারণে অনেক হ্রদ দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে। যেমন টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষের ফলে ভূমিতে ফাটল সৃষ্টি হয়ে যেসব হ্রদ সৃষ্টি হয়, সেগুলোর পানি শুকাতে দেরি হয়।
ভূমিধস, সিঙ্কহোল, বরফের বাঁধ, আগ্নেয়গিরি এবং হিমবাহ চলাচলের মতো প্রাকৃতিক ঘটনার কারণে হ্রদ সৃষ্টি হয়। হ্রদের আকার, আকৃতি ও গভীরতা নানা ধরনের হতে পারে। দুই পদ্ধতিতে হ্রদের গভীরতা মাপা হয়। একটি হলো সর্বাধিক গভীরতা, অন্যটি গড় গভীরতা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে হ্রদের গভীরতম বিন্দুর দূরত্বের বিচারে সর্বাধিক গভীরতা মাপা হয়। এর ভিত্তিতে এটলাস ডটকমে বিশ্বের গভীরতম ১০টি হ্রদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। পাঠকের জন্য এসব হ্রদের নানা তথ্য তুলে ধরা হলো।

বৈকাল হ্রদ

বৈকাল হ্রদ
ছবি: রয়টার্স

বিশ্বের সবচেয়ে গভীরতম হ্রদ রাশিয়ার বৈকাল হ্রদ। ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এই হ্রদের বয়স আড়াই কোটি বছরের বেশি। সে হিসেবে এটি বিশ্বের প্রাচীনতম হ্রদও। এটির গভীরতা ৫ হাজার ৩৮৭ ফুট। হ্রদে ৬০ প্রজাতির মাছ আছে। আছে এক প্রজাতির সিল, যা বিশ্বের আর কোথাও পাওয়া যায় না। বৈকাল বিশ্বের অহিমায়িত স্বাদু পানির ২০ শতাংশ ধারণ করে, যা প্রায় ৫ হাজার ৬৬২ ঘন মাইল স্ফটিক স্বচ্ছ স্বাদু পানির সমান এবং উত্তর আমেরিকার গ্রেট হ্রদগুলোর মোট আয়তনের চেয়েও বেশি।

টাঙ্গানিকা হ্রদ

টাঙ্গানিকা হ্রদ
ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

টাঙ্গানিকা বিশ্বের দ্বিতীয় গভীরতম হ্রদ। তানজানিয়া, গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, বুরুন্ডি এবং জাম্বিয়ায় বিস্তৃত হ্রদটি বিশ্বের দীর্ঘতম হ্রদগুলোর একটি। এটি বিশ্বের প্রায় ১৮ শতাংশ মিঠা পানির ধারণ করে, যা প্রায় ৪ হাজার ৫০০ ঘন মাইলের সমান। টাঙ্গানিকায় ছয়টি বৃহৎ দ্বীপ ও ছোট ছোট কিছু দ্বীপ রয়েছে। এই হ্রদের পানিতে আড়াই শ প্রজাতির মাছের বসবাস, যার ৯৮ শতাংশ বিশ্বের অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।

ক্যাস্পিয়ান সাগর

ক্যাস্পিয়ান সাগর
ছবি: রয়টার্স

ক্যাস্পিয়ান সাগর রাশিয়া, তুর্কমিনিস্তান, কাজাখস্তান, ইরান ও আজারবাইজান পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি প্রায় ১৮ হাজার ৮০০ ঘন মাইল পানি ধারণ করে। এর মধ্যে ১ দশমিক ২ শতাংশ পানি লবণাক্ত। যদিও এই হ্রদের সঙ্গে সমুদ্রের সঙ্গে কোনো সংযোগ নেই। এই হ্রদের ৮০ শতাংশ পানি আসে ভলগা নদী থেকে। এখানে টুনা মাছের পাশাপাশি ক্যাভিয়ার উৎপাদনকারী বেলুগা স্টারজন পাওয়া যায়। টুনা হ্রদের আশপাশের অঞ্চলের মৎস্য শিল্পের মূল কেন্দ্র। হ্রদের আশপাশের অঞ্চল এবং হ্রদের নিচে তেলের মজুত রয়েছে, যার মধ্যে কিছু তেল সংগ্রহ করা হয়েছে। এই হ্রদের সর্বোচ্চ গভীরতা ৩ হাজার ৩৬৩ ফুট।

ভস্তক হ্রদ

ভস্তক হ্রদ
ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

অ্যান্টার্কটিকার ভস্তক হ্রদের সর্বোচ্চ গভীরতা ৩ হাজার ৩০০ ফুট। এটি বিশ্বের চতুর্থ গভীরতম হ্রদ। এর নামকরণ করা হয়েছে রাশিয়ার ভস্তক স্টেশনের নামানুসারে, যা এর কাছাকাছি অবস্থিত। বরফ পৃষ্ঠের ১ হাজার ৬০০ ফুট নিচে অবস্থিত এই হ্রদের প্রায় ১ হাজার ৩০০ ঘন মাইল মিঠা পানি রয়েছে। এর পানিতে অক্সিজেন এবং নাইট্রোজেনের উচ্চ ঘনত্ব পাওয়া গেছে।

ও’হিগিন্স-সান মার্টিন হ্রদ

ও’হিগিন্স-সান মার্টিন হ্রদের সর্বোচ্চ গভীরতা ২ হাজার ৭৪২ ফুট। এটি বিশ্বের পঞ্চম গভীরতম হ্রদ। পাতাগোনিয়া অঞ্চলের হ্রদটি চিলি এবং আর্জেন্টিনায় বিস্তৃত। চিলির স্বাধীনতা আন্দোলনের দুই নেতার নামে এই হ্রদের নামকরণ করা হয়েছে। হ্রদটি চিলিতে লাগো ও’হিগিন্স এবং আর্জেন্টিনায় লাগো সান মার্টিন নামে পরিচিত। এর আকৃতি আঙুলের মতো। বিস্তৃত হ্রদটি উভয় দেশের প্লাবিত উপত্যকায় গিয়ে শেষ হয়েছে। এই হ্রদের বেশির ভাগ পানি আসে মেয়ার নদী থেকে। আর পাসকুয়া নদীর ভেতর দিয়ে এসব পানি প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবাহিত হয়।

মালাবি হ্রদ

মালাবি হ্রদ
ছবি: রয়টার্স

দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার দেশ মালাবির মোজাম্বিক ও তানজানিয়া সীমান্তের এই হ্রদের অবস্থান। এটি মোজাম্বিকে লাগো নিয়াসা এবং তানজানিয়ায় নায়াসা নামে পরিচিত। এতে প্রায় ২ হাজার ঘন মাইল মিঠা পানি রয়েছে। এটি একটি মেরোমিক্টিক হ্রদ। অর্থাৎ এতে পানির কয়েকটি পানির স্তর রয়েছে। এক স্তরের পানি আরেক স্তরের সঙ্গে মিশে না। মালাবিতে প্রায় এক হাজার প্রজাতির মাছ রয়েছে। এ হ্রদের বেশির ভাগ পানি রুহুহু নদী থেকে আসে। মালাবি হ্রদের সর্বোচ্চ গভীরতা ২ হাজার ৩১৬ ফুট।

ইসিক কুল

বিশ্বের সপ্তম গভীরতম হ্রদ ইসিক-কুল। পূর্ব কিরগিজস্তানের তিয়ান শান পার্বত্যাঞ্চলে অবস্থিত হ্রদটি একটি ভূগর্ভস্থ হ্রদ। তুষারাবৃত পর্বতশৃঙ্গ বেষ্টিত হলেও এই হ্রদে কখনো বরফ জমে না। তাই কিরগিজ ভাষায় এর নামকরণ করা হয়েছে ইসিক কুল, যার অর্থ উষ্ণ হ্রদ। এখানকার জীববৈচিত্র্য অসাধারণ। হ্রদটিকে রামসার সাইট হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। এই হ্রদের সর্বোচ্চ গভীরতা ২ হাজার ১৯২ ফুট।

গ্রেট স্লেভ হ্রদ

গ্রেট স্লেভ হ্রদ উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে গভীরতম হ্রদ। এটি কানাডার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। এই হ্রদের পশ্চিম তীর বনভূমি এবং অন্যান্য তীর তুষারাচ্ছাদিত গাছপালাবিহীন ভূমিবেষ্টিত। এই হ্রদে অনেক দ্বীপ রয়েছে। এটির সর্বোচ্চ গভীরতা ২ হাজার ১৫ ফুট।

ক্রেটার হ্রদ

ক্রেটার হ্রদ
ছবি: রয়টার্স

অসাধারণ সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত ক্রেটার হ্রদ যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগনের একটি আগ্নেয়গিরি থেকে সৃষ্ট। এটি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গভীরতম হ্রদ। গাঢ় নীল রং হ্রদটিকে দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে। প্রায় ৭ হাজার ৭০০ বছর আগে মাউন্ট মাজামার আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সৃষ্ট খাদে এই হ্রদটি গড়ে ওঠে। হ্রদটিতে পানি প্রবেশের বা বের হওয়ার কোনো পথ নেই। বাষ্পীভবনের হ্রদের পানি শুকায় এবং বৃষ্টিপাত বা তুষারপাতের মাধ্যমে পানি পূরণ হয়। এ হ্রদের সর্বোচ্চ গভীরতা ১ হাজার ৯৪৯ ফুট।

১০

মাতানো হ্রদ

সর্বোচ্চ গভীরতার দিক থেকে বিশ্বের দশম গভীরতম হ্রদ এটি। ইন্দোনেশিয়ার দক্ষিণ সুলাওয়েসিতে মাতানো হ্রদের অবস্থান। এটি ইন্দোনেশিয়ার গভীরতম হ্রদ। এটির সর্বোচ্চ গভীরতা ১ হাজার ৯৩৬ ফুট। মাতানো হ্রদের গভীরতম অংশ সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচে অবস্থিত।