চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেসের সমাপনী পর্ব চলছিল শনিবার। বেইজিংয়ের গ্রেট হলে অনুষ্ঠিত এই পর্বে উপস্থিত ছিলেন দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট হু জিনতাও। হঠাৎ সেখান থেকে তাঁকে সরিয়ে নেওয়া হয়। ওই ঘটনার ভিডিও দেখে মনে হয়েছে, হু জিনতাওয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁকে গ্রেট হল থেকে বের করে নেওয়া হয়েছে।
সাবেক প্রেসিডেন্টকে কেন এভাবে বের করে নেওয়া হলো, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা চলছে। বিষয়টি নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন। প্রশ্নগুলো হলো: হু জিনতাওকে কেন ‘জোর করে’ সরিয়ে নেওয়া হলো; গ্রেট হল থেকে বের হওয়ার আগে তিনি পাশে বসা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে কী বলেছিলেন; হু জিনতাওয়ের কোন কথার জবাবে সি সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়েছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রী লি কেছিয়াংয়ের কাঁধে হাত রেখে বলা হু জিনতাওয়ের কথাটি কী ছিল?
হু জিনতাওয়ের সঙ্গে এই আচরণের সম্ভাব্য দুটি কারণ থাকতে পারে। একটি হলো চীনের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির পূর্ণ প্রদর্শন। সেটা বোঝাতে চীনের সাবেক প্রেসিডেন্টকে প্রতীকী অর্থে সরিয়ে দেওয়া হলো। আরেকটি কারণ হতে পারে, হু জিনতাও শারীরিকভাবে গুরুতর অসুস্থ।
ঘটনাটি ঘটল সপ্তাহব্যাপী চলা কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসের শেষ সময়ে এসে। এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে চীনে মাও সে-তুংয়ের পর সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করছেন সি চিন পিং। ধারণা করা হচ্ছে, তৃতীয় মেয়াদে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও চীনের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিতে চলেছেন তিনি। গত রোববার এই কংগ্রেস শুরুর দিনেও উপস্থিত ছিলেন হু জিনতাও। তবে তাঁকে শারীরিকভাবে অনেকটা নাজুক দেখাচ্ছিল। হাঁটাচলা করতে একজনের সহায়তা নিতে হয়েছিল।
হু জিনতাওকে যদি শারীরিক অসুস্থতার কারণে কংগ্রেস থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রেও কিছু প্রশ্ন ওঠে। যেমন হঠাৎ করেই তাঁর সঙ্গে কেন এমনটা করার প্রয়োজন পড়ল, ক্যামেরার সামনেই বা কেন, আর এটা কি এতটাই জরুরি হয়ে পড়েছিল?
সম্মেলনকক্ষ থেকে ধারণ করা ভিডিওতে দেখা গেছে, হু জিনতাওকে সরিয়ে নেওয়ার সময় তাঁর দিকে ফিরেছিলেন পাশে বসা সি চিন পিং। জিনতাওয়ের বাঁ পাশে বসা দলের জ্যেষ্ঠ নেতা লি ঝানশু ও ওয়াং হানিংকেও উদ্বিগ্ন মনে হয়। একপর্যায়ে লি ঝানশু সাহায্য করতে এগিয়েও গিয়েছিলেন। তবে তাঁকে টেনে ধরেন ওয়াং হানিং, যেন বলতে চাইছেন, ‘এখানে নিজেকে জড়িয়ো না।’
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে কখন কী হবে, তা আগে থেকেই নির্ধারণ করা থাকে। ফলে হু জিনতাওয়ের সঙ্গে যে সময় ঘটনাটি ঘটেছে, তা আকস্মিক নয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদিন এই ঘটনার আগে কংগ্রেসের একটি রুদ্ধদ্বার অধিবেশন হয়।
সেখানে হু জিনতাও উপস্থিত ছিলেন। এরপর কংগ্রেসের চূড়ান্ত পর্ব ক্যামেরায় ধারণ করা হয়। ক্যামেরাগুলো চালু করার পরপরই হু জিনতাওকে সম্মেলনকক্ষ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টি সাধারণত তাদের খারাপ বিষয়গুলো প্রকাশ্যে আনে না। যদি হু জিনতাওকে সরিয়ে নেওয়ার ঘটনা ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়, তাহলে এতে বোঝা যায় যে দলটি তাদের প্রচলিত রীতিনীতি থেকে সরে আসছে।
এ ধারণাকে আরও পোক্ত করেছে হু জিনতাওয়ের চীনকে প্রতিনিধিত্ব করার ধরন। ২০০৩ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত চীনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। এ সময় পলিটব্যুরোর স্ট্যান্ডিং কমিটিতে বিভিন্ন পক্ষের প্রতিনিধিত্ব ছিল। বহির্বিশ্বের কাছেও চীন তখন অনেকটা উন্মুক্ত ছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকের কথা। সে সময় অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠান চীনে ব্যবসা শুরু করেছিল। আনাগোনা বেড়েছিল পর্যটকদের। ইন্টারনেট ব্যবহারেও বিধিনিষেধ কম ছিল। আর স্বাধীন সাংবাদিকতার সুযোগও কিছুটা দেওয়া হয়েছিল। সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চীনের সুনাম দিন দিন বাড়ছিল।
তবে সি চিন পিংয়ের শাসনামলে ভিন্ন রূপ নিয়েছে চীন। বর্তমান সরকারে চীনে জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে ভিন্নমত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সি চিন পিং দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নামে বিরোধী মতের সবাইকে রাজনীতির ময়দান থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। এখন চলতি বছরের কংগ্রেসের মাধ্যমে তাঁর পথে বাকি যেসব কাঁটা আছে, তাঁদের দূর করেছেন।
চলতি বছরের কংগ্রেস থেকে হু জিনতাও হয়তো বিষয়টি কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছেন। ২০৫ সদস্যের নতুন কমিটিতে লি কেছিয়াং ও ওয়াং ইয়াংকে রাখা হয়নি।
দুজনই হু জিনতাও প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তাঁর পরিকল্পনাগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। এটা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, পলিটব্যুরোর নতুন স্থায়ী কমিটিতে শুধু সি চিন পিংয়ের ঘনিষ্ঠরাই স্থান পেতে চলেছেন। ফলে হু জিনতাওয়ের আমলে চীনে সংস্কার ও নিজেদের উন্মুক্ত করার যে ধারা শুরু হয়েছিল, তা থেকে দেশটির সরে আসার প্রচেষ্টা আরও জোরালো হবে।