চীনে বিক্ষোভ করেছিলেন, এখন তাঁদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে প্রায় তিন বছর কঠোর বিধিনিষেধ জারি ছিল চীনে। এ বিধিনিষেধের কারণে দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির চীনকে বেশ ভুগতেও হয়েছে। বিধিনিষেধের কড়াকড়ি দেশটির মানুষের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দেয়। ক্ষোভ থেকে চীনের ক্ষমতাসীন দল কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে ‘বিরল’ বিক্ষোভও হয়। গত নভেম্বরের বিক্ষোভের পর ডিসেম্বরের শুরুতে ‘শূন্য করোনা নীতি’ থেকে সরে আসে চীন। তবে এর পর থেকে বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার শুরু করে কর্তৃপক্ষ।
বিক্ষোভে যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের অনেককে এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দেশটির কর্তৃপক্ষ চুপিসারে এসব বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করে এবং করছে।
বিক্ষোভের সময় পুলিশ কিছু বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু সেই বিক্ষোভের কয়েক মাস পর এখন অনেক বিক্ষোভকারী পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন দেশটির মানবাধিকারকর্মীরা। একটি মানবাধিকার গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে যে এখন পর্যন্ত শতাধিক বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গ্রেপ্তার এসব বিক্ষোভকারীর মুক্তি দাবি করেছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও বিদেশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়। যেসব বিক্ষোভকারী গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে একটি মানবাধিকার গোষ্ঠী। সে তালিকায় রাজধানী বেইজিং ছাড়া সাংহাই, গুয়ানঝু ও নানজিংয়ের বিক্ষোভকারীরা আছেন।
বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিয়ে জানতে বিবিসির পক্ষ থেকে চীনের সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষের কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের যে তালিকাটি একটি মানবাধিকার সংস্থা প্রকাশ করেছে, তার মধ্যে বেইজিংয়ে গ্রেপ্তার ১২ জনের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এই ১২ বিক্ষোভকারীর মধ্যে অবশ্য অন্তত ৫ জন জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। এ ছাড়া বাকি যাঁরা পুলিশের হেফাজতে আছেন, তাঁদের মধ্যে চারজন নারী। এই চার নারী হলেন কাও ঝিজিন, লি সিকি, লি ইউয়ানজিং ও ঝাই ডেংগুরি। ‘বিবাদে জড়ানো ও সমস্যা উসকে দেওয়ার’ অভিযোগে তাঁদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। চীনের দণ্ডবিধি অনুযায়ী, এ অপরাধের দায়ে সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। সমালোচকদের মতে, বিরোধী মত দমনে এ দণ্ডবিধি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
‘তাঁরা অধিকারকর্মী নন’
বিবিসি বলছে, বিক্ষোভে জড়িত থাকার কারণে যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগই উচ্চশিক্ষিত। তাঁরা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। গ্রেপ্তার বিক্ষোভকারীদের মধ্যে লেখক, সাংবাদিক, গায়ক, শিক্ষক এমনকি অর্থনৈতিক খাতে কাজ করেন এমন অনেক ব্যক্তি রয়েছেন।
বেইজিং থেকে যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁরা বন্ধুদের নিয়ে গঠিত একটি নেটওয়ার্কের অংশ। তাঁরা মূলত বন্ধুদের সংঘবদ্ধ একটি গোষ্ঠী। শিল্পের প্রতি তাঁদের ভালোবাসা অনেক। শিল্প-সাহিত্য নিয়ে একসঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনা করতেন। একসঙ্গে তাঁরা পাঠাগারে দেখা করতেন। আর তাঁরা সবাই মিলে সিনেমা দেখতেন, বেড়াতেন।
গ্রেপ্তার এসব বিক্ষোভকারীর মধ্যে অনেকেই নারী। এ ছাড়া মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, আটক করার পর পুলিশ তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদও করেছিল। জিজ্ঞাসাবাদে তাঁদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, তাঁরা নারীবাদী কি না। এ ছাড়া নারীবাদী কোনো অধিকারকর্মীর সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠতা আছে, সে সম্পর্কেও জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেখা গেছে, চীনের সরকারি কর্তৃপক্ষ নারী অধিকারকর্মীদের ওপর নজরদারি, বিধিনিষেধ আর ধড়পাকড় বাড়িয়ে দিয়েছে।
তবে কর্তৃপক্ষ গ্রেপ্তার বিক্ষোভকারীদের নারী অধিকারকর্মীর তকমা দেওয়ার চেষ্টা করলেও তাঁদের বন্ধুরা অবশ্য এটা অস্বীকার করেছেন। তাঁরা বলছেন, তাঁদের বন্ধুরা অধিকারকর্মী নন। তাঁরা তরুণদের এমন একটি দল, যাঁরা সামাজিক বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন। তাঁরা শুধু নারী নন, যেকোনো অধিকারের বিষয় নিয়ে সোচ্চার।
গত বছরের ২৭ নভেম্বর বেইজিংয়ে লিয়াংমা নদীর পাশে একটি বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন এই তরুণদের দলের কয়েকজন নারী। সেই বিক্ষোভ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। এর আগের রাতে উরমুকি নামক এলাকায় একটি বাড়িতে আগুন লেগে বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়। অনেকের ধারণা, ওই অগ্নিকাণ্ডে যাঁরা নিহত হয়েছিলেন, আগুন লাগার পর তাঁরা ভবন থেকে বের হতে পারতেন। কিন্তু করোনার বিধিনিষেধের কারণে পারেননি। যদিও সরকারি কর্তৃপক্ষ এ অভিযোগ তখন প্রত্যাখ্যান করেছিল।
এরপরই স্থানীয় ব্যক্তিরা এর প্রতিবাদে রাস্তায় নামেন। প্রতিবাদ সমাবেশ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে রূপ নেয়। বিক্ষোভকারীরা হাতে সাদা কাগজ নিয়ে ভিন্নধর্মী এক প্রতিবাদ শুরু করেন। সে বিক্ষোভে অংশ নেওয়ায় গ্রেপ্তার তরুণদের এক বন্ধু বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ অনেক দমনমূলক। আমার বন্ধুরা প্রথমে বিক্ষোভের বিষয়টি ভেবে সেই প্রতিবাদে অংশ নেয়নি। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ করতে রাস্তায় নামে তারা। পুলিশের সঙ্গেও সংঘাতে জড়ায়নি। বিষয়টিকে তারা এভাবে কখনো ভাবেনি।’
উদ্বেগ ও নিন্দা
চীনে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ ও প্রতিবাদে অংশ নেওয়া তরুণদের গ্রেপ্তার নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এ তরুণদের মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয় গোল্ডস্মিথ নিশ্চিত করেছে, গ্রেপ্তার তরুণদের একজন লি সিকি তাঁদের শিক্ষার্থী ছিলেন। চীনের পুলিশ গ্রেপ্তার করার পর পুলিশের হেফাজতে লি সিকি কেমন আছেন সে বিষয়ে ‘গভীর উদ্বেগ’ জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো এবং ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস নিশ্চিত করেছে বিক্ষোভে অংশ নেওয়ায় চীনে গ্রেপ্তার তরুণদের মধ্যে তাদেরও সাবেক শিক্ষার্থীরা রয়েছেন। ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস যথাযথ আইনিপ্রক্রিয়া ও সর্বজনীন মানবাধিকারকে গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি সুরাহার আহ্বান জানিয়েছে।
সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) জানিয়েছে, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে লি সিকিসহ চারজন সাংবাদিক। এই চার সাংবাদিককে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে সংগঠনটি বলেছে, ‘তাঁদের গ্রেপ্তার করার বিষয়টি আমাদের এই উদ্বেগপূর্ণ বার্তাই দিচ্ছে যে সরকারি ভাষ্যের বিরুদ্ধে যাওয়া সত্ত্বেও যাঁরা বিশ্বাস করে যে প্রকৃত তথ্য সবাইকে জানানো উচিত, তাঁদের কীভাবে দমন করে থাকে সরকারি কর্তৃপক্ষ।’
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) বলেছে, এ ঘটনা এটাই প্রমাণ করছে যে বাক্স্বাধীনতা ও মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার হওয়ার কারণে এর কী চরম মূল্য দিতে হচ্ছে চীনা তরুণদের। আটক ব্যক্তিদের সমর্থন দেওয়ায় তাঁদের বন্ধু ও আইনজীবীদের হুমকি দিচ্ছে চীনা কর্তৃপক্ষ।