‘সেলা টানেল’ বানিয়ে চীনকে কী বার্তা দিতে চাচ্ছে ভারত

নরেন্দ্র মোদি ও সি চিন পিংছবি: রয়টার্স

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অরুণাচল প্রদেশে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৩ হাজার ফুট উঁচুতে পার্বত্য এলাকায় টানেল নির্মাণ করেছে মোদি সরকার। এই টানেল নির্মাণ নিয়ে সীমান্ত ঘিরে ভারত ও চীনের মধ্যে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে।

চলতি মাসের গোড়ার দিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘সেলা টানেল’ উদ্বোধন করেন। এত উচ্চতায় দুই লেনের ওই টানেল বিশ্বে সর্ববৃহৎ বলা হচ্ছে। আসামের তেজপুর থেকে যাওয়া ওই সড়ক সামরিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটিকে প্রকৌশল জগতের ‘অসাধারণ কীর্তি’ হিসেবে দেখছে ভারত।

ওই টানেল নির্মাণের ফলে চীন-অরুণাচল প্রদেশ সীমান্তের অগ্রবর্তী এলাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে সামরিক সরঞ্জাম অতি দ্রুত নেওয়া সম্ভব হবে। চীন সীমান্তবর্তী তাওয়াংয়ের সঙ্গেও সব মৌসুমে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হবে।

এই ‘সেলা টানেল’ নজরে এসেছে বেইজিংয়ের। কয়েক বছর ধরে ২ হাজার ১০০ মাইল (৩ হাজার ৩৭৯ কিলোমিটার) দীর্ঘ সীমান্তে দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে নানা বিতর্ক ও উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে। এমনকি দুই পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ পর্যন্ত হয়েছে।

সর্বশষে ২০২০ সালে আকসাই চীন-লাদাখ সীমান্তে চীন ও ভারতের সেনাবাহিনীর মধ্যে হাতাহাতি হয়েছিল। তখন ভারতের ২০ ও চীনের ৪ সেনা নিহত হয়েছিলেন।

কয়েক দশকের বিতর্কের ফলশ্রুতিতে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধও বেঁধেছিল।

চীন দাবি করে আসছে, যেখানে টানেল নির্মাণ করা হয়েছে, সেই অরুণাচল প্রদেশ তাদের। অবশ্য বর্তমানে এই অঞ্চল ভারতের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

সম্প্রতি চীনের কর্মকর্তারা অরুণাচল প্রদেশে ভারতের টানেল নির্মাণ প্রকল্প এবং সেখানে প্রধানমন্ত্রী মোদির সফরের কড়া সমালোচনা করেছেন। তাঁরা অভিযোগ তুলেছেন, দিল্লি সীমান্তের শান্ত পরিস্থিতিকে খাটো করে দেখছে।

গত সপ্তাহে চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র অরুণাচল প্রদেশের নাম চীনা ভাষায় ‘জাঙ্গনান’ বা দক্ষিণ তিব্বত উল্লেখ করে বলেছেন, সীমান্ত পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলতে পারে, এমন যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে আমরা ভারতীয় পক্ষকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। চীনের সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছে এবং প্রয়োজনে তারা জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা সুদৃঢ়ভাবে রক্ষা করবে।’

ভারতও গত মঙ্গলবার কড়া জবাব দিয়েছে। চীনের দাবিকে তারা ‘অবাস্তব’ বলে উল্লেখ করে বলেছে, ওই অঞ্চল ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং সব সময়-ই তা ভারতের থাকবে।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরও গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে ভারতের সার্বভৌমত্বের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। কোনো ভূখণ্ড নিজের দাবি করে বিদ্যমান সীমান্ত বা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলএসি) অতিক্রম করে একতরফা অনুপ্রবেশ বা দখল করার বিষয়ে সতর্কতা উচ্চারণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

বেইজিংও যুক্তরাষ্ট্রকে ছেড়ে কথা বলেনি। বেইজিং অভিযোগ তুলেছে, নিজেদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থে অন্য কোনো দেশকে উসকানি দেওয়া বা অন্য কোনো দেশের মাধ্যমে সুবিধা আদায় থেকে ওয়াশিংটনের বিরত থাকা উচিত।

নতুন করে এই বিতর্ক এশিয়ার বৃহত্তম দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলেছে। এই বিতর্ক এমন একসময়ে শুরু হয়েছে, যখন ভারতে জাতীয় নির্বাচনের ঢামাঢোল বাজতে শুরু করেছে। এই নির্বাচনে মোদির হিন্দুত্ববাদী দলের জয়ের সম্ভাবনা প্রবল।

মোদির ভারতে জাতীয়তাবাদের প্রবল উত্থানের পাশাপাশি চীনেও অনুরূপ পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং কঠোর পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছেন। অবশ্য দুই পক্ষই ২০২০ সালের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর সীমান্ত পরিস্থিতি শান্ত রাখতে পদক্ষেপ নিয়েছে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অরুণাচল প্রদেশে ৯ মার্চ সেলা টানেলের উদ্বোধন করেন
ছবি: এএনআই

এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) নরেন্দ্র মোদি লিখেছেন, ভারত-ভুটান অংশীদারত্বকে আরও সুসংহত করতে গত শুক্রবার তিনি থিম্পু সফরে গেছেন। দুর্গম হিমালয় অঞ্চলের এসব দেশের সঙ্গে অরুণাচল প্রদেশের সীমান্ত রয়েছে। এই সীমান্ত নিয়েও দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা রয়েছে। এখানে যেকোনো স্থাপনা নির্মাণের বিষয়ে ভারত সতর্ক দৃষ্টি রাখছে।

চলতি মাসের শুরুর দিকে অরুণাচল প্রদেশ সফরকালে নরেন্দ্র মোদি ‘সেলা টানেল’ নির্মাণকাজের প্রশংসা করে এটিকে ‘প্রকৌশলের বিষ্ময়’ বলে উল্লেখ করেন। সেখানে তিনি সীমান্তে অবকাঠামো নির্মাণসহ আরও বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরুর কথা বলেন।

যেসব সীমান্তে ঝামেলা রয়েছে, সেখানে নিজেদের ভূখণ্ডে ভারত সরকার উন্নয়ন কাজ জোরদার করেছে। ভারত সরকারের ধারণা, উন্নয়নকাজ না হলে সেসব দুর্গম অঞ্চলে চীনের আক্রমণ, অনুপ্রবেশ বা দখলের আশঙ্কা তৈরি হবে। বেইজিং বলছে, তারা ভারতের তৎপরতা ঘনিষ্ঠভাবে নজরদারি করছে।

চীনের সঙ্গে বিতর্কিত সীমান্ত এলাকায় ভারতের বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন (বিআরও) গত বছর সড়ক, সেতু ও বিমানঘাঁটি মিলিয়ে ১১৮টি প্রকল্পের কাজের উদ্বোধন করেছে। এসব প্রকল্পের অর্ধেকই অরুণাচল প্রদেশ ও লাদাখে।

বেইজিং অভিযোগ করছে, সীমান্ত এলাকায় এ ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প চালু করে ভারত দুই দেশের সীমান্ত পরিস্থিতিকে জটিল ও বিপর্যয়কর করে তুলছে।

তবে ভারতের পক্ষে দাবি করা হচ্ছে, সীমান্ত এলাকায় সড়ক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নকাজ করে চীন সেখানে সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়ে নয়াদিল্লির চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থান রয়েছে। ওই সব এলাকায় চীন অসংখ্য গ্রাম তৈরি করে সেখানে মানুষের বসবাসের ব্যবস্থা করেছে। তবে বেইজিং অভিযোগ নাকচ করে বলেছে, ভারত যেমনটা দাবি করছে, সীমান্তে তারা অন্য কারও এলাকা দখল বা শক্তি প্রয়োগ করেনি।

সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইয়েউ স্কুল অব পাবলিক পলিসি’স সেন্টার অন এশিয়া অ্যান্ড গ্লোবালাইজেশনের গবেষণা সহযোগী বায়রন চং বলেন, ভারত এখন সীমান্তে অবকাঠামো নির্মাণের সুফল উপলব্ধি করছে। তারা এখন চীনকে মোকাবিলায় সীমান্তে অবকাঠামো নির্মাণ করছে। কিন্তু তাদের এই উদ্যোগ সীমান্তে চীনের সঙ্গে উত্তেজনা বাড়াচ্ছে এবং চীনকে সীমান্তে আরও বেশি অবকাঠামো নির্মাণ ও শক্তি বৃদ্ধিতে উৎসাহিত করছে।

আসাম রাজ্য থেকে অরুণাচল প্রদেশের তাওয়াং পর্যন্ত ‘সেলা টানেল’ নির্মাণ করা হয়েছে। স্পর্শকাতর এলাকা বিশেষ করে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলএসি) বরাবর নির্মিত এই টানেল ইতিমধ্যে বেইজিংয়ের নজর কেড়েছে। নয়াদিল্লি বলছে, এই প্রকল্প সশস্ত্র বাহিনীকে দ্রুত প্রস্তুত ও সীমান্ত এলাকায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহের কাজকে সহজ করবে।

২০২২ সালের শেষ দিকে তাওয়াং সীমান্ত এলাকায় দুই দেশের সৈন্যদের মধ্যে হাতাহাতি হয়েছিল। তখন নয়াদিল্লি অভিযোগ করেছিল, চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির সেনারা ‘একতরফা’ এলএসি অতিক্রম করে সীমান্তের স্থিতিবস্থা নষ্ট করার চেষ্টা করেছিল।

ব্যাঙ্গালুরুর তক্ষশীলা ইনস্টিটিউশনের ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় স্টাডিজ গবেষণাকেন্দ্রের প্রধান মনোজ কেওয়ালরামনি বলেন, তিব্বতের বৌদ্ধ গুরুদের কারণে বেইজিংয়ের কাছে তাওয়াং অঞ্চলের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। আবার দালাইলামার সম্ভাব্য উত্তরসূরি নিয়েও চীনের উদ্বেগ রয়েছে।

৮৮ বছর বয়সী দালাইলামা ১৯৫৯ সালে চীনশাসিত তিব্বতে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেন। তখন থেকে তিনি ভারতে নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন। ওই সময় তিব্বতের ধর্মীয় নেতাদের ওপর ব্যাপক ধরপাকড় চালায় বেইজিং এবং তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মগুরুদের প্রভাব কমিয়ে আনার চেষ্টা শুরু করে।

মনোজ কেওয়ালরামনি বলেন, অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে এখন ব্যাপক চাপ রয়েছে। এ নিয়ে ভারতের কাছ থেকে চীন কী ধরনের প্রতিক্রিয়া চায় বা এ নিয়ে কবে বিতর্কের অবসান হবে—সব কিছু নিয়ে একধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে।

দুই দেশ সীমান্তের আশপাশে নানা অবকাঠামো নির্মাণ করে চলেছে। চীন এই অঞ্চলকে নিজেদের দাবি করে তাঁদের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করেছে। তাঁরা অরুণাচল প্রদেশের চীনা নামও দিয়েছে। আবার এটাও ঠিক, ২০২০ সালের ভয়াবহ সংঘাতের পর দুই দেশ কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

গত আগস্টে দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকসের শীর্ষ সম্মেলনের এক ফাঁকে বৈঠক করেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেখানে তাঁরা উত্তেজনা প্রশমনে ‘উদ্যোগ জোরদার’ করতে সম্মত হন।

ভারত ও চীনের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা সীমান্তে নিয়মিত আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। গত মাসেও দুই পক্ষ আলোচনায় বসেছিল। ওই বৈঠকেও তারা সীমান্তে ‘শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায়’ রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।