চীন কি সামরিক সক্ষমতায় সবাইকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে
চীনের চোখধাঁধানো সমরাস্ত্র প্রদর্শনীর পর তাদের সামরিক সক্ষমতা নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। লোয়ি ইনস্টিটিউটের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিচালক স্যাম রোগিভিন চীনের সামরিক শক্তির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের একটা তুলনা করেছেন। ৩ সেপ্টেম্বর তাঁর লেখাটি ফরেন পলিসির অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে।
চীনের সামরিক সমরাস্ত্র প্রদর্শনীর পর এখন এটি ব্যাপকভাবে স্বীকৃত যে চীনের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সম্পর্কে পশ্চিমা দেশগুলো নিজেদের যে গল্প শোনাত, তা মোটেই যথেষ্ট নয়। গল্পটি ছিল এমন—চীন কেবল পশ্চিমা প্রযুক্তির নকল করে, তারা মেধাস্বত্ব চুরি করে এবং তাদের সাফল্যগুলো কেবলই অপচয়মূলক সরকারি অনুদানের ফল।
এ গল্পের কিছু সত্যতা এখনো থাকলেও আগের মতো আর সত্য নয়। বর্তমানে চীন রোবোটিকস, বৈদ্যুতিক যান, পারমাণবিক চুল্লি, সৌরশক্তি, ড্রোন, উচ্চগতির রেলপথ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) মতো ক্ষেত্রে উদ্ভাবক ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে নেতৃত্বের অবস্থানে চলে গেছে।
আরও নিশ্চিত হওয়ার প্রয়োজন অনভূত হলে ৩ সেপ্টেম্বর বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত সামরিক কুচকাওয়াজের দিকে নজর দিতে হবে। ওই দিন চীনের শক্তি প্রদর্শন এ সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে যে সামরিক প্রযুক্তিতে চীন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এ মুহূর্তে আর এটি বলা যথেষ্ট নয় যে চীনের সামরিক বাহিনী, পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) কেবল অন্যদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে অথবা বিদেশি সামরিক সরঞ্জামের নকশা নকল করছে।
আসল কথা হচ্ছে, চীন এখন উদ্ভাবন করছে এবং এ ক্ষেত্রে তারা নেতৃত্ব দিচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় আঞ্চলিক সামরিক ভারসাম্য, যা বহু দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের পক্ষে ছিল, তা এখন পরিবর্তিত হচ্ছে এবং এই পরিবর্তন অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
‘জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চীনা জনগণের প্রতিরোধ যুদ্ধ এবং বিশ্ব ফ্যাসিবাদবিরোধী যুদ্ধের’ ৮০তম বার্ষিকী উপলক্ষে অনুষ্ঠিত বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজটি ছিল চীনের বর্তমান সামরিক শক্তির এক প্রদর্শনী এবং দেশটির সামরিক শক্তির ভবিষ্যতের একঝলক। চীন সাধারণত তাদের অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম দেখাতে রাজি হয় না। কিন্তু এবারের অনুষ্ঠানে তারা সে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। যদিও তা ছিল কিছুটা বাছাই করা।
আসল কথা হচ্ছে, চীন এখন উদ্ভাবন করছে এবং এ ক্ষেত্রে তারা নেতৃত্ব দিচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় আঞ্চলিক সামরিক ভারসাম্য, যা বহু দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের পক্ষে ছিল, তা এখন পরিবর্তিত হচ্ছে এবং এই পরিবর্তন অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
এ কুচকাওয়াজের উল্লেখযোগ্য দিকগুলোর মধ্যে ছিল চীনের ক্রমবর্ধমান বিমানবাহী জাহাজের বহরের জন্য নির্মিত বিমানগুলোর প্রদর্শন। বর্তমানে তাদের বহরে তিনটি জাহাজ রয়েছে। তবে আগামী বছরগুলোতে অন্তত একটি পারমাণবিক শক্তিচালিত সুপারক্যারিয়ার যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের নতুন জেরাল্ড ফোর্ড শ্রেণির মতোই বড় ও সক্ষম।
কুচকাওয়াজে চার ধরনের নতুন ‘লয়াল উইংম্যান’ ড্রোন উন্মোচন করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে মনুষ্যবিহীন স্টিলথ বিমান, যা পাইলটচালিত বিমানের পাশাপাশি উড়ে এবং তাঁদের নির্দেশে কাজ করে। এ ছাড়া অন্তত চারটি নতুন ধরনের জাহাজবিধ্বংসী এবং ভূমি থেকে ভূমিতে হামলার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা, সেই সঙ্গে নতুন একটি মনুষ্যবিহীন সাবমেরিন এবং নতুন টর্পেডো প্রদর্শন করা হয়েছে।
এই কুচকাওয়াজ ছিল চীনের সামরিক শিল্প খাত পর্যবেক্ষণকারীদের জন্য উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো একটি বছরের সর্বশেষ প্রকাশ। ২০২৪ সালের বড়দিনের পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুটি নতুন স্টিলথ কমব্যাট বিমানের পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের অস্পষ্ট ভিডিও এবং ছবি দেখা যেতে শুরু করে।
সে ঘটনার কয়েক সপ্তাহ পরে ‘নেভাল নিউজ’–এর প্রতিবেদনে জানানো হয়, চীন একধরনের অনন্য শক্তিচালিত বার্জ তৈরি করছে, যার সঙ্গে এক্সটেন্ডেবল রাস্তা সংযোগকারী সেতু রয়েছে। ফলে গাড়ি বহনকারী জাহাজগুলো অপ্রস্তুত উপকূলীয় এলাকায় মালপত্র খালাস করতে পারবে। পরবর্তী সময়ে এসব বার্জের পরীক্ষামূলক ছবি নিশ্চিত করে, তাইওয়ান আক্রমণের সময় ভারী সাঁজোয়া যানগুলোকে তীরে নামানো সহজ করতে এগুলো দারুণ কাজ করবে।
পরে জানুয়ারির শেষের দিকে ‘ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস’ বাণিজ্যিক উপগ্রহের ছবি প্রকাশ করে দেখায়, বেইজিংয়ের বাইরে চীন একটি নতুন সামরিক কমান্ড সেন্টার নির্মাণ করছে, যা পেন্টাগনের চেয়ে অন্তত ১০ গুণ বড়।
গত মে মাসে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে চার দিনের সংঘাতের সময় ১২৫টি বিমান ব্যবহার করা হয়। দুই দেশ এভাবে আকাশযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানের বিমানবাহিনী চীনের সরঞ্জাম ব্যবহার করে। সীমিত প্রমাণ থেকে দেখা যায়, সেগুলো বেশ বিশ্বাসযোগ্যভাবে কাজ করেছে।
চীনে সম্পূর্ণ দেশীয় একটি সামরিক শিল্প খাত গড়ে তোলার সব লক্ষণ দেখাচ্ছে। চীনের নেতৃত্ব এই শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে বিশ্বমানের একটি সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছে। এর জন্য অবশ্যই প্রযুক্তির চেয়েও বেশি কিছু প্রয়োজন। সম্প্রতি চীনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান ইঙ্গিত দিচ্ছে যে পিএলএর মধ্যে গুরুতর দুর্নীতি ও কার্যকারিতার সমস্যা রয়েছে।
কুচকাওয়াজে চার ধরনের নতুন ‘লয়াল উইংম্যান’ ড্রোন উন্মোচন করা হয়েছে। এগুলো হলো মনুষ্যবিহীন স্টিলথ বিমান, যা পাইলটচালিত বিমানের পাশাপাশি উড়ে এবং তাদের নির্দেশে কাজ করে। এ ছাড়া অন্তত চারটি নতুন ধরনের জাহাজবিধ্বংসী এবং ভূমি থেকে ভূমিতে হামলার ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা, সেই সঙ্গে নতুন একটি মনুষ্যবিহীন সাবমেরিন এবং নতুন টর্পেডো প্রদর্শন করা হয়েছে।
তবে প্রযুক্তিগত দিক থেকে চীনের উচ্চাকাঙ্ক্ষার যথেষ্ট প্রমাণ অনেক আগে থেকেই ছিল। চীন ১৯৯০–এর দশকের গোড়ার দিকে সামরিক বাহিনীতে তাদের আধুনিকীকরণ শুরু করে। তখন থেকে পিএলএ সম্ভবত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যেকোনো সামরিক বাহিনীর তুলনায় সবচেয়ে দ্রুত প্রযুক্তিগত রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গেছে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে পাওয়া তথ্যগুলো চীনের ডিজিটাল রূপান্তরের বিষয়টিকে আরও জোরদার করেছে। ফলে এখন এই প্রশ্ন উত্থাপন করা উচিত যে চীনের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে এখনো কি অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে?
চীন কী করতে চায়
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, এই বিশাল সামরিক শক্তি দিয়ে চীন কী করতে চায়?
একটি সম্ভাবনা হতে পারে, তারা এমন একটি বাহিনী তৈরি করছে, যা সত্যিকারের বৈশ্বিক সামরিক অবস্থানের মাধ্যমে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করবে।
গত ফেব্রুয়ারিতে যখন পিএলএ নৌবাহিনী তাদের যুদ্ধজাহাজের একটি বহর নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার চারপাশ ঘুরে আসে, তখন দূরবর্তী অস্ট্রেলিয়া চীনের নতুন সক্ষমতার বিষয়টি টের পায়। এটি এমন একটি বার্তা দিচ্ছে যে চীনের সামরিক শক্তির বিস্তার এখন নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে।
তবু গত ৯ মাসের প্রকাশিত তথ্য থেকে যে মূল কথা বোঝা যায়, তা হলো চীন শুধু প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বা বিশ্বের অন্য কোথাও সামরিক শক্তি প্রদর্শনের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে না। আমরা যে নতুন অস্ত্র বা সরঞ্জাম দেখছি, তার অনেকটাই আসলে সেই উদ্দেশ্যে তৈরি নয়।
আবার এটাও ঠিক, এমন সরঞ্জাম অনেক কাজে লাগানো যেতে পারে। এতে কোনো সন্দেহ নেই, গত কয়েক দশকে চীন দূরবর্তী নিশানায় সামরিক শক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে। তারা কৌশলগত বিমানবহর তৈরি করছে, যা তাদের দ্রুত বিশ্বজুড়ে জনবল ও সরঞ্জাম পরিবহনে সাহায্য করবে।
সম্প্রতি চীন তাদের আকাশপথে জ্বালানি সরবরাহের বহরও বাড়াতে শুরু করেছে। দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের বহর যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিকভাবে বিমানশক্তি প্রদর্শনের একটি মূল বৈশিষ্ট্য ছিল। চীনের এখন ডজন ডজন ‘ব্লু ওয়াটার’ (খোলা সমুদ্রে পরিচালনার উপযোগী) যুদ্ধজাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে বিমানবাহী জাহাজ এবং জাহাজের বহরকে সমুদ্রে সচল রাখতে জ্বালানি সরবরাহের জন্য জাহাজও অন্তর্ভুক্ত।
তবে এটাও বিবেচনা করতে হবে, ২০১৭ সালে জিবুতিতে তাদের একটি মাত্র বিদেশি ঘাঁটির পর চীন আর কোনো নতুন ঘাঁটি স্থাপন করেনি। আন্তমহাদেশীয় পাল্লার বোমারু বিমান মোতায়েন করা থেকে তারা এখনো বহু বছর দূরে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো কোনো বৈশ্বিক জোট তাদের নেই।
এ বছর উন্মোচিত নতুন যুদ্ধবিমান, অবতরণ জাহাজ, ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা—এসব থেকেও মনে হচ্ছে না, চীন বিশ্বজুড়ে শক্তি প্রদর্শনে মন দিচ্ছে। বরং এগুলো মূলত নিজেদের আশপাশের এলাকায় প্রাথমিকভাবে তাদের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে।