জলবায়ুবিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত জন কেরি চীনে পৌঁছেছেন। গতকাল রোববার তিনি বেইজিংয়ে পৌঁছান। চার দিনের এই সফরকালে চীন সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে জলবায়ু ইস্যু নিয়ে আলোচনা করবেন কেরি।
দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বিশ্বের সবচেয়ে দূষণকারী দুই দেশও বটে। এখন মূল প্রশ্ন হলো, গুরুত্বপূর্ণ জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দেশ দুটি চলমান কূটনৈতিক উত্তেজনা এড়াতে পারবে কি না।
চীনের সঙ্গে স্থবির হয়ে পড়া সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তারই অংশ হিসেবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেনের পর সর্বশেষ উচ্চপদস্থ মার্কিন কর্মকর্তা হিসেবে বেইজিং সফর করছেন কেরি।
সফরকালে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক চীনের বিশেষ প্রতিনিধি শেই ঝেনহুয়ার সঙ্গে বৈঠক করবেন কেরি। মার্কিন বিশেষ এই দূতের দপ্তর জানিয়েছে, জলবায়ুবিষয়ক পদক্ষেপ বাস্তবায়ন ও এ নিয়ে ক্রমবর্ধমান উচ্চাকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি একটি সফল কপ-২৮ সম্মেলন নিশ্চিত করতে তিনি চীনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলবেন। জাতিসংঘের এই জলবায়ুবিষয়ক সম্মেলন চলতি বছরের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
দুই দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যকার এই বৈঠক থেকে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত আসবে, এমনটা আশা করা হচ্ছে না। তবে এই বৈঠককে সংলাপের সূচনা হিসেবে দেখা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে অগ্রসর হওয়া এবং কার্বন নির্গমন কমানোর ক্ষেত্রে অভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়ে তাঁরা আলোচনা করবেন।
এক পর্যালোচনায় দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী। বিশ্বের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে শুধু চীনের একার বিনিয়োগই অর্ধেকের বেশি।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্বালানিবিষয়ক অধ্যাপক ড্যান কামেন বলেন, দেশ দুটি আবার বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গমনকারীও। জ্বালানি খরচ, ব্যবহার ও দূষণের দিক থেকে দেশ দুটি ‘জি-২’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। তিনি বলেন, এর ফলে উভয় দেশই বড় ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে, কিন্তু গ্যাস নির্গমনের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না।
স্ববিরোধী পদক্ষেপ
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চাহিদা ও গ্যাস নির্গমন কমানো—এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য আনতে দুই সরকার স্পষ্টত এখনো হিমশিম খাচ্ছে। এ জন্য দেশ দুটিকে স্ববিরোধী পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে, যার সমালোচনা করে আসছেন পরিবেশবাদীরা।
এটি খুব বেশি দিন আগের ঘটনা নয় যে চীন কয়লানির্ভর জ্বালানির ওপর থেকে নির্ভরতা কমানোর আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আগের বছরগুলোতে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি অবকাঠামো জোরদারের পর ২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং কার্বন নিয়ন্ত্রণ লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেন।
বেইজিং ও অন্যান্য শহরে বছরের পর বছর ক্রম অবনতিশীল ধোঁয়াশাপূর্ণ পরিবেশ জনমনে ব্যাপক আতঙ্কের সৃষ্টি করে। এতে কর্তৃপক্ষ কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দিতে নিজ থেকেই উদ্যোগ নেয় এবং কয়লার উৎপাদন কমিয়ে আনে।
কিন্তু এই সিদ্ধান্তের পর দেশটিতে লোডশেডিং বাড়তে থাকে। একই সঙ্গে করোনাভাইরাস মহামারি-পরবর্তী অর্থনীতিতে অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক উভয় ক্ষেত্রেই চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় চীনের কারখানাগুলো উৎপাদন বাড়ায়। অতি গরম ও অতি শীতের কারণেও বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যায়।
এরপর চীন জ্বালানি নিরাপত্তার ওপর জোর দেয়। দেশটি আবার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ফিরে যায়। বায়ু ও সৌরবিদ্যুতের তুলনায় এটাকে তুলনামূলক নির্ভরযোগ্য মনে করে দেশটি। গত বছর দেশটি ব্যাপকভাবে কয়লার উৎপাদনও বাড়ায়।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে কয়েক শ কোটি ডলার বিনিয়োগে সম্প্রতি দুটি আইন পাস করেছে। কিন্তু একই সঙ্গে দেশটি আলাস্কায় গত কয়েক বছরের মধ্যে অন্যতম বড় তেল ও গ্যাস উত্তোলন প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে।
কী থাকতে পারে আলোচনায়
বিশ্লেষকেরা বলছেন, চীনকে দেশটির নবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং আরও দ্রুত কার্বন নিয়ন্ত্রণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিষয়ে রাজি করানোর চেষ্টা করবেন কেরি। বেইজিং ২০৬০ সালকে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য স্থির করেছে।
চলতি মাসের শুরুর দিকে মার্কিন অর্থমন্ত্রী ইয়েলেন জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে লড়াইরত গরিব দেশগুলোকে সাহায্য করতে ধনী দেশগুলোর প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিলে অনুদান দিতে বেইজিংয়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
জলবায়ু ইস্যুতে সমঝোতার ক্ষেত্রে সম্প্রতি চীনের তৈরি সৌরবিদ্যুতের সরঞ্জামের ওপর পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রে আরোপিত শুল্ক প্রত্যাহারের বিষয়ে তুলতে পারে বেইজিং। কার্বন নির্গমনের ওপর ভিত্তি করে বিদেশে তৈরি ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর শুল্ক আরোপের মার্কিন প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করতে পারে চীন। কারণ, এতে দেশটির রপ্তানি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, উভয় পক্ষই নিজেদের বৃহত্তর বাণিজ্য ও রাজনৈতিক স্বার্থ আদায়ে জলবায়ু ইস্যুকে দর-কষাকষির উপাদান হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
গ্রিনপিসের পূর্ব এশিয়ার জ্যেষ্ঠ বৈশ্বিক নীতি উপদেষ্টা লি শুও বলেন, দুই দেশের সম্পর্কের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হার মানতে রাজি হবে না চীন। তবে তিনি বলেন, শেই ও কেরির উচিত হবে তুলনামূলক এই শান্ত সময়কে কাজে লাগিয়ে জলবায়ু সংলাপ থেকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আলাদা রাখা।