বেলুন–কাণ্ডে চীনের যত প্রতিক্রিয়া

মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন ফেব্রুয়ারির শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে চীনা বেলুন শনাক্তের ঘোষণা দেয়
ছবি: এএফপি

বেলুন–কাণ্ড নিয়ে চীন বারবার তার অবস্থান পরিবর্তন করছে। বেইজিংয়ের এই দফায় দফায় অবস্থান বদলের সবশেষ নমুনা হলো, চীনের আকাশসীমায় বেলুন ওড়ানোর জন্য তারা যুক্তরাষ্ট্রকে দোষারোপ করেছে।

বেলুন–কাণ্ডের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত চীনের প্রতিক্রিয়াগুলো কেমন ছিল, তা এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছেন বিবিসির টেসা ওং ও ফ্যান ওয়াং।

দুই সপ্তাহ আগে যুক্তরাষ্ট্র তার আকাশে একটি ‘চীনা গুপ্তচর বেলুন’ শনাক্তের কথা জানায়। ৪ ফেব্রুয়ারি ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে বেলুনটি ধ্বংস করে যুক্তরাষ্ট্র। বেলুন–কাণ্ড নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যে উত্তেজনা দেখা দেয়, তা এখনো অব্যাহত।

বেলুন–কাণ্ডে চীনা সরকার ও জনগণের দিক থেকে নানা প্রতিক্রিয়া আসতে দেখা গেছে। এসব প্রতিক্রিয়ার মধ্যে ক্ষোভ ও জল্পনা—উভয়ই রয়েছে।

নীরবতা, পরে স্বীকারোক্তি

মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন ২ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে চীনা বেলুন শনাক্তের ঘোষণা দেয়। কিন্তু এ বিষয়ে চীনা কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানানো থেকে বিরত থাকেন।

পরের দিন সন্ধ্যায় চীন নীরবতা ভাঙে। এক বিবৃতিতে বেইজিং স্বীকার করে, যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে শনাক্ত হওয়া বস্তুটি চীনের। তবে চীন দাবি করে, বস্তুটি একটি বেসামরিক আকাশযান। এটি গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছিল। মূলত আবহাওয়া–সংক্রান্ত কাজে বস্তুটি ব্যবহার করা হচ্ছিল। বস্তুটি বাতাসের কারণে ভুল পথে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছে।

বেইজিং ক্ষমা প্রার্থনার সুরে বিষয়টিকে একটি দুর্ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করে। তারা বলে, অনিচ্ছাকৃতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে বস্তুটি ঢুকে পড়ার ঘটনায় তারা দুঃখিত। এমন সুরে বেইজিংয়ের কথা বলার বিষয়টি বিরল।

চীনা সরকারের এমন স্বীকারোক্তির আগপর্যন্ত দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম এ বিষয়ে চুপ ছিল। কিন্তু এই ইস্যুতে পরবর্তীকালে তারা আরও রক্ষণাত্মক হয়ে ওঠে। চায়না ডেইলি দাবি করে, বানোয়াট বেলুন তত্ত্বের সঙ্গে চীনকে যুক্ত করা যাবে না।

অন্যদিকে, গ্লোবাল টাইমস এই ঘটনায় চীনের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক পদক্ষেপ না নিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানায়। বরং চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে আরও আন্তরিক হতে বলে।

ঘটনাটি নিয়ে চীনা নেটিজেনদের রসিকতা করতে দেখা গেছে। অনেকে বস্তুটিকে ‘দ্য ওয়ান্ডারিং বেলুন’ নামে ডাকেন। জনপ্রিয় চীনা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি ও চলচ্চিত্র ‘দ্য ওয়ান্ডারিং আর্থ’-এর কথা মাথায় রেখে তাঁরা এমন রসিকতা করেন।

পরদিন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন তাঁর পরিকল্পিত চীন সফর বাতিল করেন। এই ঘটনার পর চীনা কর্তৃপক্ষ একটি দীর্ঘ ও অধিকতর জোরালো রক্ষণাত্মক বক্তব্য প্রকাশ করে। বেইজিং দাবি করে, যুক্তরাষ্ট্রের কিছু রাজনীতিবিদ ও গণমাধ্যম চীনকে দোষী করতে ঘটনাটিকে অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরছে।

যুক্তরাষ্ট্র বেলুনটি ভূপাতিত করলে চীন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং এই পদক্ষেপকে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া হিসেবে বর্ণনা করেন। একে তিনি অগ্রহণযোগ্য ও দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ বলে অভিহিত করেন।

বেলুনের অবশিষ্টাংশ ফেরত দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে চীন অনুরোধ করেছে কি না, তা মাও নিংয়ের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। জবাবে তিনি বলেন, আকাশযানটি যুক্তরাষ্ট্রের নয়, এটি চীনের।

চীনের কর্মকর্তারা এই ঘটনায় বেইজিংয়ের মার্কিন দূতাবাসে একটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দেন। চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, অনুরূপ পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয় উপায় ব্যবহারের অধিকার বেইজিং রাখে।

অনলাইনে চীনা জাতীয়তাবাদীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের নিন্দা করেন। বিশিষ্ট চীনা ভাষ্যকার ও গ্লোবাল টাইমসের সাবেক প্রধান সম্পাদক হু শিজিন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে হয়েছে। কারণ, তারা দুর্ঘটনার পেছনের সত্য অনুসন্ধানে সক্ষম নয়। সত্য অনুসন্ধানের পরিবর্তে তারা ঘটনাটিকে নিয়ে রাজনীতি করেছে।

এই ডামাডোলের মধ্যে লাতিন আমেরিকার ওপর দিয়ে আরেকটি বেলুন উড়ে যেতে দেখা যায়। এই বেলুনটিও চীনের বলে স্বীকার করে বেইজিং।

জল্পনা-কল্পনা

যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে যাওয়া বেলুনটি ঠিক কে উড়িয়েছে, তা নিয়ে চীনের ইন্টারনেট পরিসরে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়। কারণ, বেলুনটির বেসামরিক উত্স সম্পর্কে বিশদ বিবরণ কোথাও নেই।

অতি উচ্চতায় উড়তে সক্ষম—এমন বেলুন বানিয়ে থাকে চীনের স্থানীয় কোম্পানি চেম চায়না ঝুঝো রাবার রিসার্চ অ্যান্ড ডিজাইন ইনস্টিটিউট। এ নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত নানা খবর নিয়েও অনেকে কথা বলেন।

কিছু চীনা ব্লগার দাবি করেন, চীনের একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সহযোগী এই ইনস্টিটিউটই বেলুনটি তৈরি করেছে। তবে বেলুনটি ওড়ানোর সঙ্গে ইনস্টিটিউটের কোনো সংযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

দ্য পেপার নামের একটি সংবাদমাধ্যমের এক প্রতিবেদনের জেরে বিভ্রান্তি আরও গভীর হয়। প্রতিবেদনে চীনের পূর্ব শানডং প্রদেশের উপকূলে একটি অজ্ঞাত বস্তু ওড়ার কথা বলা হয়। চীনা মৎস্য কর্মকর্তারা স্থানীয় জেলেদের এ বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, চীনা কর্তৃপক্ষ বস্তুটিকে গুলি করে ভূপাতিত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

প্রতিবেদনটি চীনের অন্য কিছু সংবাদমাধ্যমও ছাপিয়েছিল। তবে এ বিষয়ে চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমসহ সরকারি বিভাগগুলো নিশ্চুপ ছিল।

উল্টো অভিযোগ

গত সোমবার চীন সরকার একটি নতুন দাবি করে বসে। তারা বলে, গত এক বছরে কমপক্ষে ১০ বার যুক্তরাষ্ট্রের বেলুন চীনের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে।

চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ছিল প্রথমে নিজেদের বিষয়ে পরিষ্কার থাকা। চীনকে দোষারোপের পরিবর্তে তাদের উচিত ছিল নিজেদের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করা।

চীনের এই অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্র অস্বীকার করেছে। চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম এখন একটি ভিন্ন বিষয় গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করছে। তারা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের ওহিওতে বিপজ্জনক উপাদান বহনকারী একটি লাইনচ্যুত ট্রেন রয়েছে।

ঘটনাটি ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে ঘটেছিল। কিন্তু চীনা সংবাদমাধ্যমগুলো এখন তা ফলাও করে প্রচার করছে। মার্কিন কর্মকর্তাদের ভাষ্য, দূষণ রোধে ট্রেন থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক সতর্কতার সঙ্গে তাঁরা বের করেছেন।

তবে অনেক চীনা নেটিজেনরা বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছেন। তাঁরা বলছেন, এটি একটি বৈশ্বিক পরিবেশগত সংকটে রূপ নিতে পারে। আর গুরুতর ইস্যুটি মার্কিন গণমাধ্যমে কম গুরুত্ব পাচ্ছে।