তিয়েনআনমেন স্কয়ারে সেদিন যেভাবে বিক্ষোভ দমন করা হয়েছিল

আশির দশকে চীনে রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল ছিল বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ার। বিক্ষোভকারীদের দমন করতে ৩ জুন রাতে ব্যাপক অভিযান শুরু করে চীনের তৎকালীন সরকার। সেনাবাহিনী ভারী অস্ত্র আর ট্যাংক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আন্দোলনকারীদের ওপর। হতাহত হয় বিপুলসংখ্যক আন্দোলনকারী। সেই ঘটনা নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন।

ট্যাংকের গতি রোধ করে দাঁড়ানো সেই ব্যক্তি।ফাইল ছবি: এপি

ট্যাংকের সারির গতিরোধ করে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক ব্যক্তি। যেকোনো সময় ঘনিয়ে আসতে পারে মৃত্যু। তবে তিনি অকুতোভয়। ইন্টারনেটে প্রায়ই এমন একটি ছবি ঘুরেফিরে আমাদের চোখে বাঁধে। ছবিটি হয়ে উঠেছে বিপ্লব, বিদ্রোহ, প্রতিবাদের প্রতীক। আমরা অনেকেই হয়তো ছবিটির পেছনের গল্পটা জানি না।

এ বিষয়ে জানতে হলে ফিরতে হবে বেশ খানিকটা অতীতে—চীনে। ১৯৮৯ সালে চীন তখন উত্তাল। রাজনীতি ও অর্থনীতিতে পরিবর্তন আনার দাবিতে রাজধানী বেইজিংয়ে চলছে বিক্ষোভ। এর মূল কেন্দ্র ছিল শহরটির তিয়েনআনমেন স্কয়ার। বিক্ষোভ দমাতে ঠিক ৩৪ বছর আগে ৩ জুন রাতে তিয়েনআনমেন স্কয়ারে জনতার ওপর অস্ত্র হাতে হামলে পড়ে চীনের সরকারি বাহিনী। হত্যা করা হয় শত শত মানুষকে।

ওই বিক্ষোভকারীদের একজন ছিলেন ট্যাংকের সামনে দাঁড়ানো ওই ব্যক্তি। শেষ পর্যন্ত ট্যাংকগুলোকে থামাতেও পেরেছিলেন। পরে ঘটনাস্থলে থাকা দুজন তাঁকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যান। ওই ব্যক্তি কে ছিলেন বা তাঁর পরিণতি কী হয়েছিল, তা আর কখনোই জানা যায়নি। তবে এক নামে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পেয়েছেন—‘ট্যাংকম্যান’।

ট্যাংকম্যানের ছবিটি স্থান করে নিয়েছে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর তালিকায়। ঘটনার পরদিন ৫ জুন সেটি ফলাও করে পশ্চিমা গণমাধ্যমে ছাপানো হয়েছিল। ছবিটি তুলেছিলেন আলোকচিত্রী স্টুয়ার্ট ফ্রাঙ্কলিন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘এই ছবির মধ্য দিয়ে ওই মানুষটির অসাধারণ সাহস ফুটে উঠেছে। সমাজে ন্যায়বিচার ফিরিয়ে আনার জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে যেন তৈরি ছিলেন তিনি।’

যে পথে শুরু হয়েছিল বিক্ষোভ

গত শতকের আশির দশকে ব্যাপক বদলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল চীন। দেশটিতে বেসরকারি খাতে কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার অনুমতি দিয়েছিল ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি। বিদেশি বিনিয়োগও আসা শুরু করেছিল। চীনের অর্থনীতি ও মানুষের জীবনমানকে এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন কমিউনিস্ট নেতা দেং জিয়াওপিং।

অর্থনীতির বিকাশে সরকারের এই তৎপরতা ঘিরে আবার শুরু হয়েছিল দুর্নীতি। কমিউনিস্ট পার্টির নেতারাও বিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। দলের অনেকেই মনে করতেন, অর্থনীতির এই পরিবর্তন আরও দ্রুত হওয়া উচিত। অনেকে আবার কঠোর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের পক্ষে ছিলেন। এমনই পরিস্থিতিতে আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন। ১৯৮৯ সালে আন্দোলন আরও ছড়িয়ে পড়ে।

এরই মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির উদারপন্থী নেতা হু ইয়াওবাংয়ের মৃত্যু বিক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। তিনি অর্থনৈতিক বিকাশের পক্ষে ছিলেন। সে বছরের এপ্রিলে ইয়াওবাংয়ের প্রতি শোক জানাতে তিয়েনআনমেন স্কয়ারে জড়ো হন চীনের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সংস্কারের যে প্রতিশ্রুতি সরকার দিয়েছিল, তাতে ধীরগতি ও দুর্নীতির জন্য ক্ষোভও প্রকাশ করেন তাঁরা।

বিক্ষোকারীদের রাজপথ থেকে সরাতে ১৯৮৯ সালের ৩ জুন রাতে বেইজিংয়ে নামানো হয় সামরিক বাহিনী। মোতায়েন করা হয় হাজারো সেনা, শত শত ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান।

তিয়েনআনমেন স্কয়ারে শুরু হওয়া শান্তিপূর্ণ এই বিক্ষোভ পরে চীনের অন্যান্য প্রদেশেও ছড়িয়ে পড়ে। এর নেতৃত্বে ছিলেন শিক্ষার্থীরাই। ১৩ মে তাঁরা তিয়েনআনমেন স্কয়ারে অনশনে বসেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল, কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের আলোচনায় বসতে রাজি করানো। শিক্ষার্থীরা যে সংস্কারের দাবি তুলেছিলেন, তাতে সমর্থন জানিয়ে সে সময় বেইজিংয়ে ১০ লাখ মানুষ জড়ো হয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়।

বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে বিক্ষোভকারীরা
ফাইল ছবি: রয়টার্স

পরে ১৯ মে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেখা করেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা। সেদিন সন্ধ্যায় অনশন শেষ করেন শিক্ষার্থীরা। এর পরদিনই কঠোর হস্তে বিক্ষোভ দমন করতে বেইজিংয়ে মার্শাল ল জারি করে সরকার। এতে আবার চটে যান বিক্ষোভকারীরা। বেইজিংসহ সারা দেশের রাজপথে নামেন হাজার হাজার বিক্ষোভকারী। এরপরই আসে সেই কালরাত।

চীনের নতুন প্রজন্মের ওই হত্যাকাণ্ড নিয়ে ধারণাও খুব একটা স্পষ্ট নয়। এর কারণও আছে। তিয়েনআনমেন স্কয়ারে হত্যাকাণ্ড নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা দেশটিতে স্পর্শকাতর একটি বিষয় হিসেবে দেখা হয়।

রাজপথে সামরিক বাহিনী

বিক্ষোভকারীদের রাজপথ থেকে সরাতে ১৯৮৯ সালের ৩ জুন রাতে বেইজিংয়ে নামানো হয় সামরিক বাহিনী। মোতায়েন করা হয় হাজারো সেনা, শত শত ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান। কোনো হুঁশিয়ারি ছাড়াই তিয়েনআনমেন স্কয়ারে বিক্ষোভকারীদের ওপর চালানো হয় নির্বিচার গুলি। গুলিতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ যায় অনেকের। অনেকে চাপা পড়েন ট্যাংক ও সাঁজোয়া যানের নিচে।

এ ঘটনায় কত মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, তা আজও জানা যায়নি। জুনের শেষের দিকে চীন সরকার জানিয়েছিল, তিয়েনআনমেন স্কয়ারের ওই ঘটনায় ২০০ বেসামরিক মানুষ ও বেশ কয়েকজন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য নিহত হয়েছিলেন। তবে ধারণা করা হয়, এই সংখ্যাটা কয়েক হাজার।  

২০১৭ সালে একটি কূটনৈতিক তারবার্তা প্রকাশ করেছিল যুক্তরাজ্য সরকার। বার্তাটি পাঠিয়েছিলেন সে সময় চীনে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যার অ্যালান ডোনাল্ড। তাতে তিনি বলেছিলেন, সেনাবাহিনীর হাতে তিয়েনআনমেন স্কয়ারে প্রায় ১০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।

তিয়েনআনমেন স্কয়ারের ওই হত্যাযজ্ঞের চিত্র আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কাছে তুলে ধরেছিলেন এক বিক্ষোভকারী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘সেদিন আমরা আহত বিক্ষোভকারীদের স্ট্রেচারে করে নিয়ে তিয়েনআনমেন স্কয়ার থেকে সরে যাচ্ছিলাম। দেখতে পেলাম সেনা সদস্যরা বড় বড় প্লাস্টিকের ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছেন। ওই ব্যাগের মধ্যে মানুষের মরদেহ ছিল। তবে কতজনের মরদেহ, তা বলতে পারব না।’

তিয়েনআনমেন স্কয়ারের বর্তমান চিত্র
ফাইল ছবি: রয়টার্স

অনেককে নাকি তিয়েনআনমেন স্কয়ার থেকে দূরে নিয়েও হত্যা করা হয়েছিল। অ্যামনেস্টিকে ওই বিক্ষোভকারী বলেন, ‘অনেক লোকজনকে সেনা সদস্যরা ঘিরে রেখেছিলেন। তাঁদের লাথি দিচ্ছিলেন। আমি মানুষের চিৎকার ও গুলির শব্দও শুনতে পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল সেখানে ২০০ জনের মতো মানুষ ছিলেন। জুলাই মাসের শুরুর দিকে পুলিশের এক সূত্র থেকে জানতে পেরেছিলাম, তাঁদের সবাইকে বেইজিংয়ের কাছের একটি গ্রামে নিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।’  

বিক্ষোভকারীদের ওপর সামরিক বাহিনীর ওই নৃশংসতার পরপরই ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে চীন সরকার। বিদ্রোহের অভিযোগ এনে দেশজুড়ে হাজার হাজার মানুষকে আটক করা হয়। তাঁদের কাউকে নির্যাতনের পর কারাবন্দী করা হয়। অনেকের কপালে জোটে মৃত্যুদণ্ড। তবে কতজনকে আটক করা হয়েছিল বা কারাদণ্ড ও মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়েছিল, তা কখনোই প্রকাশ করেনি চীন।

নিষিদ্ধ এক বিষয়

তিয়েনআনমেন স্কয়ারে হত্যাকাণ্ডের শিকার মানুষগুলোকে চীন সরকার পরিচয় দিয়েছে ‘বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী’ হিসেবে। তাঁদের পরিবারের সদস্যরা কখনোই এই হত্যাকাণ্ডের বিচার পাননি। এমনকি প্রকাশ্যে শোক প্রকাশও করতে পারেননি। ওই ঘটনা যেন চীনে এক নিষিদ্ধ বিষয়।

চীনের নতুন প্রজন্মের কাছে ওই হত্যাকাণ্ড নিয়ে ধারণাও খুব একটা স্পষ্ট নয়। এর কারণও আছে। তিয়েনআনমেন স্কয়ারে হত্যাকাণ্ড নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা দেশটিতে স্পর্শকাতর একটি বিষয় হিসেবে দেখা হয়। এই হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত কোনো বিষয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ইন্টারনেটে প্রকাশ হলেও তা সরিয়ে দেওয়া হয় সরকারের নির্দেশে।

১৯৮৯ সাল থেকে তিয়েনআনমেন স্কয়ার নিয়ে কথা বলার জন্য চীনে অনেককেই কারাবন্দী করা হয়েছে। ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরকারকে জড়িয়ে প্রশ্ন তোলায় একই পরিণতি হয়েছে অনেকের। তাঁদের একজন মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা আইনজীবী চো হাং–তুং। ২০২১ সালে তাঁকে হংকং থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

চীনে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মায়া ওয়াং বলেন, ‘চীন ও হংকং থেকে তিয়েনআনমেন স্কয়ার হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি মুছে দিতে চাইছে চীন সরকার। তবে দেশটিতে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে যাঁরা সবকিছু ঝুঁকিতে ফেলেছিলেন, ৩৫ বছর পরও তাঁদের ইতিহাসের পাতা থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়নি।’

  • তথ্যসূত্র: অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, বিবিসি, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ