চীনের এক সন্তান নীতির বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা

চীনে দম্পতিরা তিন সন্তান নিতে পারবেন, এমন সিদ্ধান্তে দেশটিতে অনলাইনে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। চীনা সরকারের এ নীতি গ্রহণ অনেক দেরি হয়ে গেল কি না, এ নিয়ে চলছে আলোচনা। দেশটিতে সন্তান জন্মের হার কমে যাওয়ায় গত সোমবার নতুন পরিবার পরিকল্পনা নীতি গ্রহণ করে চীনা সরকার। অবসর গ্রহণের বয়সসীমাও বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয় একই দিন। এ সিদ্ধান্ত নিয়েও সমালোচনা চলছে।

বিবিসির খবরে বলা হয়, নতুন সিদ্ধান্ত ঘোষণা হওয়ার পর অতীতে এক সন্তান নীতির কারণে মানসিক বিপর্যয়ের মুখে পড়া চীনা নাগরিকদের অনেকে ক্ষতিপূরণের দাবি তুলেছেন। ১৯৭৯ সালে কঠোর এক সন্তান নীতি চালু করে চীন। এ নীতি ভঙ্গের কারণে অনেক পরিবার জরিমানার মুখে পড়ে, অনেকে চাকরি হারান, এমনকি জোরপূর্বক গর্ভপাতেরও শিকার হন।

আরও পড়ুন

চীনে এক সন্তান নীতি অনেক বিতর্কিত বিষয়ের জন্ম দেয়। অধিকারকর্মীরা বলছেন, এ নীতির ফলে মেয়েসন্তানের ভ্রুণ নষ্ট করার প্রবণতা তৈরি হয়। ফলে মেয়েসন্তান জন্মহারও কমে যায়। ৪০ বছর ধরে এ নীতি বহাল ছিল দেশটি। ২০১৬ সালে নীতিটি থেকে বেরিয়ে আসে চীন। এরপর থেকে দম্পতিরা দুটি সন্তান নিতে পারতেন। অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও জনশক্তির কথা বিবেচনা করে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বলে দাবি করা হয় তখন।

চীনা মাইক্রোব্লগ উইবোতে এক ব্যক্তি দাবি করেন, তাঁকে জন্ম দেওয়ার পর তাঁর মা জন্মনিরোধ পদ্ধতি গ্রহণ করতে বাধ্য হন। ওই ব্যক্তি ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান। এমন পরিস্থিতির শিকার হয়ে তাঁর মা এখনো শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। তিনি আরও বলেন, ‘এটা ছিল শীতল এক নীতি। এর ফলে বোঝা যেত না কী পরিমাণ সমস্যার মুখে পড়তে হতো।’

অনলাইনে উঠে আসে ফেঙ্গ জিয়ামির ঘটনাও। ২০১২ সালে এ নারী তাঁর দ্বিতীয়বারের মতো অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন। ওই সময় এক সন্তান নীতি লঙ্ঘন করায় ফেঙ্গ ও তাঁর স্বামীকে জরিমানা করে কর্তৃপক্ষ। জরিমানা না দেওয়ায় সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ফেঙ্গকে জোরপূর্বক গর্ভপাত করানো হয়। এ ঘটনা সে সময় ব্যাপক আলোচিত ছিল।

জিয়া শুয়াই নামের আরেক ব্যক্তি উইবোতে লেখেন, এক সন্তান নীতি ভঙ্গ করে তাঁর জন্ম হওয়ায় ‘অবৈধ শিশু’ হিসেবে তিনি বড় হয়ে উঠেছিলেন। তা–ও গ্রামাঞ্চলে লুকিয়ে। পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তারা যখনই বাড়ি বাড়ি গিয়ে কোনো বাড়িতে কতজন আছে সেই খোঁজ নিতেন, তখনই তিনি পুকুরে ডুব দিয়ে লুকিয়ে থাকতেন।

কারণ, নীতি ভঙ্গের কারণে জরিমানা দিতে হতো। সেটা পরিশোধ না করলে ঘর খালি করে জিনিসপত্র বা পোষাপ্রাণী নিয়ে যাওয়া হতো।

আরও পড়ুন

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন দাবি করেন, তাঁর বোনকে এখনো একা থাকতে হচ্ছে। কারণ, তাঁর মা তখন আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন, তখন তাঁকে গর্ভপাত ঘটানোর জন্য হাসপাতালে ডাকা হয়। পরে এক চিকিৎসকের দয়ায় তিনি হাসপাতাল থেকে পালাতে সক্ষম হন।

আরেক উদাহরণ চলচ্চিত্র নির্মাতা ঝ্যাং ইমো ও তাঁর স্ত্রী। ২০১৪ সালে এক সন্তান নীতি ভঙ্গের কারণে তাঁদের ১২ লাখ ডলার জরিমানা গুনতে হয়েছিল।

এক সন্তান নীতির কারণে চীনের অনেক পরিবারকে এমন সব বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। নতুন নীতি গ্রহণের পর চীনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেসব ঘটনা তুলে ধরছে মানুষ। কেউ কেউ আবার সন্তান নেওয়ার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এক সন্তান নীতির কারণে আর সন্তান নিতে না পারায় তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি তুলেছেন।

মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, এখনো এই নীতি আগের মতোই যৌন ও প্রজনন অধিকারের লঙ্ঘন। সংস্থাটির চীনের প্রধান জোসোয়া রোজেনউইেগ বলেন, লোকজন কটি সন্তান নেবেন, সে বিষয়ে সরকার নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত নয়। জন্মনীতির প্রণয়নের চেয়ে বরং চীনের উচিত ব্যক্তিপছন্দকে সম্মান জানানো এবং পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে আক্রমণাত্মক ও শাস্তিমূলক নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করা।

আরও পড়ুন

চীনে সন্তান জন্মের হার উদ্বেগজনকভাবে কমে যাওয়ায় পরিবার পরিকল্পনার নতুন এ নীতি গ্রহণ করল দেশটি। ১৯৬০-এর দশকের পর সন্তান জন্মের হার দেশটিতে সবচেয়ে কম। চীনের জনসংখ্যা জরিপ থেকে জানা গেছে এমন তথ্য। ন্যাশনাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিক গত মাসে জানিয়েছে, গত বছর দেশটিতে ১ কোটি ২০ লাখ শিশুর জন্ম হয়েছে। ২০১৬ সালে দেশটিতে ১ কোটি ৮০ লাখ শিশুর জন্ম হয়। সরকারি সংস্থাটি আরও বলেছে, দেশটিতে প্রজননের হার ১ দশমিক ৩। দেশটিতে জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখার জন্য যে জন্মহার থাকা প্রয়োজন, তার চেয়ে কম এই হার।