টিকা পাসপোর্টের সুবিধা-সতর্কতা

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের (কোভিড–১৯) সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর দেশগুলো যার যার মতো করে পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। ভাইরাসের বিস্তার রোধে কোনো দেশে লকডাউন, কোনো দেশে শাটডাউন করা হয়। কেউ কেউ সীমান্ত বন্ধ করে দিয়ে বাইরে থেকে মানুষের প্রবেশ ঠেকায়। দেশের ভেতরে চলাচল–মেলামেশায় আরোপ করা হয় নানান বিধিনিষেধ। এসব করে একটা পর্যায় পর্যন্ত ঠেকানো গেছে ভাইরাস। এখন দেওয়া হচ্ছে টিকা।

কিন্তু বিশ্ব থেকে করোনা কত দিনে নির্মূল করা যাবে, তা এখনো কেউ জানে না। তাই সাবধানতা মেনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে নেওয়া হচ্ছে নানা পদক্ষেপ। এর মধ্যে একটি বড় পদক্ষেপ হতে পারে ‘টিকা পাসপোর্ট’।

ধারণাটি নতুন এবং এর কিছু বিরূপ প্রভাবও দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কেননা টিক নেওয়া মানুষেরাই এই টিকা পাসপোর্ট পাচ্ছেন বা পাবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিশ্বের শতাধিক দেশে এখনো পর্যন্ত একটি মানুষও টিকা পায়নি। তাঁদের কী হবে?

আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, ইতিমধ্যে, চীন, ইসরায়েলসহ কয়েকটি দেশ ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক ভ্রমণ বা পর্যটনের মতো করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনৈতিক খাত পুনরুজ্জীবিত করতে নিজেদের মতো করে টিকা পাসপোর্টের প্রচলন করেছে। যাঁরা করোনাভাইরাসের টিকা নিয়েছেন, তাঁদের একধরনের সনদ দেওয়া হচ্ছে। এতে ওই ব্যক্তিরা অবাধে দেশে ও দেশের বাইরে চলাচলের সুযোগ পাবেন।

তবে সংশয়বাদীরা সতর্ক করে বলছেন, টিকা পাসপোর্টের নতুন ধারণা গ্রহণ করার আগে এর সম্ভাব্য সুদূরপ্রসারী বিরূপ প্রভাবের বিষয় বিবেচনা করা দরকার।

টিকা পাসপোর্ট কি?

বিস্তৃত অর্থে টিকা পাসপোর্টকে ছোট্ট একটি নথি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায়, যার মাধ্যমে কেউ কোভিড–১৯–এর টিকা নিয়েছেন, সে বিষয়টিকে প্রমাণ করা যাবে। এটি সই করা ও স্ট্যাম্পসংবলিত সনদ বা মুঠোফোনের কিউআর কোডও হতে পারে। যথাযথ কর্তৃপক্ষই এটি দেবে।

যুক্তরাজ্যের নফিল্ড কাউন্সিল অন বায়োথিক্সের চেয়ার ডেভ আর্চার্ড আল–জাজিরাকে বলেন, বিদেশে ভ্রমণ থেকে শুরু করে নাট্যশালা ও রেস্তোরাঁয় ঢোকার মতো নানা ক্ষেত্রে টিকা পাসপোর্ট কাজে লাগানো যেতে পারে।

টিকা নেওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করার এমন পদ্ধতি নিয়োগদানের ক্ষেত্রে ‘বৈষম্যমূলক’ পরিস্থিতি বা ‘দ্বিস্তরবিশিষ্ট সমাজ’–ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে পারে বলে সতর্ক করে দেন ডেভ আর্চার্ড। তিনি বলেন, বিশেষত ওই সব ক্ষেত্রে এই অবস্থা তৈরি হতে পারে, যেখানে কাউকে উন্মুক্ত স্থানে প্রবেশ করা বা দেশের ভেতরে যাতায়াতের জন্য কিছু সামাজিক রীতির অংশ হিসেবে নথিভুক্তিকরণ প্রয়োজন হয়।

টিকা পাসপোর্ট নিয়ে কেন আলোচনা?

করোনা নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন দেশ গণহারে টিকাদান কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। করোনাকালে আন্তর্জাতিক ভ্রমণ স্বাভাবিক করতে সীমান্তগুলো আবার নিরাপদে খুলে দেওয়া এবং কঠোর লকডাউন কর্মসূচির কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া অর্থনীতিকে গতিশীল করার একটি সম্ভাবনাময় কৌশল হয়ে উঠেছে টিকা পাসপোর্ট।

তত্ত্বগতভাবে, টিকা গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলে, অর্থাৎ টিকা পাসপোর্ট এ মহামারি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ মোড় সৃষ্টিকারী পদক্ষেপ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এতে টিকা নেওয়া পর্যটকদের সার্বজনীনভাবে স্বাগত জানাতে পারে বিভিন্ন দেশ। পাশাপাশি সংক্রমণের আতঙ্ক কাটিয়ে বিশেষত পর্যটনের মতো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলো পুরোপুরি খুলে দিতে পারে দেশগুলো।

বাস্তবে নতুন পাসপোর্ট (টিকা গ্রহণের সনদ) কীভাবে কাজ করবে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তা ছাড়া এ ব্যবস্থায় বৈষম্য বেড়ে যাওয়া, গোপনীয়তা লঙ্ঘন ও এমনকি কোভিড–১৯ নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা ক্ষতিগ্রস্ত করার সম্ভাবনা নিয়েও উদ্বেগ আছে।

কোথায়, কীভাবে টিকা পাসপোর্ট ব্যবহার হচ্ছে?

নিজস্ব ধাঁচে টিকা পাসপোর্ট বা সনদের ব্যবহার এরই মধ্যে শুরু করে দিয়েছে কিছু দেশ। যদিও এই ধারণা নিয়ে কোনো বৈশ্বিক ঐকমত্য এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

উদাহরণস্বরূপ ইসরায়েলের কথা বলা যায়। দেশটি গ্রিন পাস নামে সরকার অনুমোদিত টিকা পাসপোর্ট চালু করেছে। এই সনদের মাধ্যমে সেখানকার লোকজন প্রমাণ দেখাতে পারছেন যে তাঁরা কোভিড–১৯ প্রতিরোধে টিকা নিয়েছেন ও তাঁরা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে যথেষ্ট সক্ষমতার অধিকারী।

এই পাসপোর্টের মেয়াদ ছয় মাস। টিকা পাসপোর্টধারীরা করোনা বিধিনিষেধের আওতায় থাকা বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অনেকটাই বাধাহীনভাবে অংশ নিতে পারছেন। যেমন তাঁরা ব্যায়ামাগার, রেস্তোরাঁ বা নাট্যশালায় যেতে পারছেন। বিদেশে যাওয়ার সুযোগ ও কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থাও এড়াতে পারছেন।

টিকা পাসপোর্ট চালুর মাধ্যমে ইসরায়েল গ্রিস ও সাইপ্রাসের সঙ্গে একটি চুক্তিতেও এসেছে। এর অধীন টিকার সনদধারী ব্যক্তিরা এ তিন দেশের মধ্যে অবাধে যাতায়াত করার সুযোগ পাচ্ছেন। একই রকমের ব্যবস্থা নিয়েছে চীন ও বাহরাইন। অন্যদিকে ডেনমার্ক ও সুইডেন এমন কর্মসূচি চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছে।