নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার সংকেত দিচ্ছে চীন?

চীনের সাম্প্রতিক একটি হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা দুশ্চিন্তায় ফেলেছে মার্কিন প্রশাসনকে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

চীনের সাম্প্রতিক একটি হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা দুশ্চিন্তায় ফেলেছে মার্কিন প্রশাসনকে। চীনের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার বিষয়টি সামনে আনে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমস। নানা সূত্রের বরাত দিয়ে দাবি করা হয়, পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে ছোড়া হয়েছিল ক্ষেপণাস্ত্রটি। তবে ভূপৃষ্ঠে সেটি লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারেনি। এমন দাবি সরাসরি নাকচ করে দেয় চীন। জানায়, তারা আদতে পুনরায় ব্যবহার করা যায়, এমন মহাকাশযানের পরীক্ষা চালিয়েছিল।

বিবিসির খবরে জানা যায়, ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার বিষয়টি নাকচ করার মধ্য দিয়ে চীন ‘বিভ্রান্তি ছড়াতে চাইছে’ বলে মনে করেন ক্যালিফোর্নিয়ার মিডলবেরি ইনস্টিটিউটের ‘ইস্ট এশিয়া নন-প্রলিফিরেশন প্রোগ্রামের’ পরিচালক জেফরি লুইস।

চীন সম্প্রতি যে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রটির পরীক্ষা চালিয়েছে, সেখানে ‘অরবিটাল বোম্বার্ডমেন্ট সিস্টেম-এফওবি’ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। এই প্রযুক্তিতে রকেটের মাধ্যমে ক্ষেপণাস্ত্র পৃথিবীর কক্ষপথে পাঠানো হয়। পরে সময়মতো সেটি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে।

এফওবি প্রযুক্তির সুবিধা হলো, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে অবস্থানের কারণে ক্ষেপণাস্ত্রটি রাডার এবং প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এড়িয়ে চলতে পারে। যদিও এফওবি প্রযুক্তি একেবারেই নতুন নয়। গত শতকে স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে এই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। এবার চীন সেটি নতুন করে সামনে আনল।
চীন যে এমন ধরনের প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে, তা বেশ কয়েক মাস ধরে জানিয়ে আসছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ স্থানীয় কর্তাব্যক্তিরাও। তবে প্রশ্ন উঠেছে, কেন চীন এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালাল? এ নিয়ে জেফরি লুইস বলেন, বেইজিং আশঙ্কা করছে, আসছে দিনগুলোতে প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্র অত্যাধুনিক সব পারমাণবিক অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ব্যবহার করবে। তাই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাঁরা।

সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারমাণবিক ক্ষমতাধর প্রায় সব দেশই হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়নে কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে দেশগুলোর ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে বলে মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া অঙ্গরাজ্যের ফরেন ইনস্টিটিউটের গবেষণা পরিচালক অ্যারন অস্টিন। তাঁর মতে, বেইজিং ও মস্কো হাইপারসনিক প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য। বিপরীতে হাঁটছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা এই ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে আঘাত হেনে প্রতিপক্ষের পারমাণবিক অস্ত্রের কাঠামো ভেঙে দিতে চাইছে।

তবে অ্যারন অস্টিনের সঙ্গে মতের অমিল রয়েছে অনেকের। তাঁদের মধ্যে রয়েছে কার্নেগি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের কর্মকর্তা জেমস অ্যাকশন। তাঁর ভাষ্য, চীনের এই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা নতুন হুমকি নয়। ১৯৮০ সাল থেকেই যুক্তরাষ্ট্র চীনের পারমাণবিক হামলার ঝুঁকিতে রয়েছে। রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন জেমস অ্যাকশন। তিনি বলছেন, ৯/১১ সন্ত্রাসী হামলার পর যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, বর্তমান অবস্থা তার চেয়েও জটিল। বিভিন্ন দেশের ‘ধ্বংসাত্মক’ পররাষ্ট্রনীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র দিন দিন নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছে।

ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিতে চীনের অগ্রগতির পেছনে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রকেই অনেকটা দায়ী করেছেন এই বিশেষজ্ঞ। ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়ন সীমিত করতে ১৯৭২ সালে ‘অ্যান্টি ব্যালিস্টিক মিসাইল’ চুক্তি করা হয়। ২০০২ সালে ওই চুক্তি থেকে সরে যায় যুক্তরাষ্ট্র। এর জের ধরে চীন এমন বাড়াবাড়ি করার সুযোগ পাচ্ছে বলে মনে করেন জেমস অ্যাকশন।

ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশ পিছিয়ে রয়েছে চীন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কারণেই তারা সমরাস্ত্র তৈরিতে আরও আগ্রহী হচ্ছে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। তাঁরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অত্যাধুনিক সব অস্ত্র চীনকে দুশ্চিন্তার মধ্যে ফেলছে।

একই ভাবে ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়নের প্রতিযোগিতায় বেশ এগিয়েছে উত্তর কোরিয়া। বৈশ্বিক কূটনীতিতে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতেই দেশটির এমন সব কর্মকাণ্ড বলে জানিয়েছেন কার্নেগি এনডোমেন্ট অব ন্যাশনাল পিসের কর্মকর্তা অঙ্কিত পান্ডা। তিনি বলেন, উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অন্য দেশগুলোর মতো একই আচরণের দাবি করে আসছিল। এবার সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে গুরুত্ব পাওয়ার চেষ্টা করছে দেশটি। সবকিছু মিলিয়ে মার্কিন প্রশাসনের ওপর চাপ বাড়ছে।

অস্ত্র প্রতিযোগিতা সামলাতে যুক্তরাষ্ট্রকে আলোচনায় বসা জরুরি বলে মনে করছেন অঙ্কিত পান্ডা। তিনি বলেন, ক্ষেপণাস্ত্র ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র আলোচনায় বসলে রাশিয়া ও চীনের কাছ থেকে সাড়া মিলবে। একই ভাবে পরমাণু অস্ত্রের পেছনে ছোটা থেকেও নিরুৎসাহিত হবে দেশগুলো।