আমাদের মহাজগতজুড়ে থাকা নক্ষত্রগুলো সুবিশাল থেকে সুবিশালতর। আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র সূর্যের ব্যাস ১৪ লাখ কিলোমিটার। এটি এতটাই বড় যে এর ভেতরে দিব্যি পৃথিবীর সমান ১৩ লাখ গ্রহের জায়গা হয়ে যাবে। তবে মহাবিশ্বে আরও যত বিশাল বিশাল নক্ষত্র আছে, সে তুলনায় সূর্যের আকার আহামরি কিছু নয়। বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বে এমন এমন কিছু নক্ষত্রের সন্ধান পেয়েছেন যেগুলোর আকার সূর্যের চেয়ে হাজার গুণ বড়।
তাহলে মহাবিশ্বের বৃহত্তম নক্ষত্র কোনগুলো? এমন প্রশ্নটি সামনে চলে আসে।
বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত মহাবিশ্বে যতগুলো বড় বড় নক্ষত্রের সন্ধান পেয়েছেন তার মধ্য থেকে সবচেয়ে বড় ১০টি নক্ষত্রের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে বিবিসি সায়েন্স ফোকাস। তালিকা অনুযায়ী ১০ বড় নক্ষত্র হলো—ইউওয়াই স্কুটি, ডব্লিউওএইচ জি ৬৪, ডব্লিউওএইচ ৫১৭০, আরএসজিসি১-এফ০১, এইচডি ২৬৯৫৫১, ভিওয়াই ক্যানিস ম্যাজোরিস, এইচডি ১২৪৬৩, সিএম ভেলোরাম, এএইচ স্করপি এবং এইচভি ৮৮৮। সব কটির আকার সূর্যের চেয়ে বড়।
এই ১০ বড় নক্ষত্র–সম্পর্কিত কিছু তথ্য প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
মহাবিশ্বে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় নক্ষত্রটির নাম ইউওয়াই স্কুটি। লাল রঙের বিশাল এই নক্ষত্র সূর্যের চেয়ে ১ হাজার ৭০৮ গুণ চওড়া। এর ব্যাসার্ধ ১২০ কোটি কিলোমিটার (৭৩ কোটি ৮০ লাখ মাইল)। ইউওয়াই স্কুটির অবস্থান পৃথিবী থেকে প্রায় ৯ হাজার ৫০০ আলোকবর্ষ দূরের স্কুটাম নক্ষত্র মণ্ডলে। এই নক্ষত্র মণ্ডলটি মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা নামের ছায়াপথের কেন্দ্রের দিকে অবস্থিত।
আকারে অনেক বড় হওয়ার পরও ইউওয়াই স্কুটি নক্ষত্রটির তাপমাত্রা আমাদের সূর্যের তুলনায় ৪০ শতাংশ কম। এর তাপমাত্রা ৩ হাজার ৯২ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১ হাজার ৭০০ ফারেনহাইট)। তাপমাত্রা কম হওয়ার একটা কারণ হলো, নক্ষত্রটি ইতিমধ্যে এর হাইড্রোজেন জ্বালানির বেশির ভাগটাই ফুরিয়ে ফেলেছে। এই হাইড্রোজেন জ্বালানিই উষ্ণতা ও আলো তৈরি করে। তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত কম হওয়ার এটি লালচে আভা ছড়ায়।
ইউওয়াই স্কুটির বয়সও আশ্চর্য রকমের কম। এর বয়স মাত্র ১ কোটি থেকে ২ কোটি বছর। আমাদের সূর্যের বয়স ৪৬০ কোটি বছর। অবশ্য, ইউওয়াইয়ের জ্বালানি যেভাবে দ্রুত নিঃশেষিত হচ্ছে, তাতে কয়েক লাখ বছর পর এর জীবনচক্র ফুরিয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
জীবনচক্র ফুরিয়ে যাওয়ার পর ইউওয়াই স্কুটি নক্ষত্রটির কী হবে, তা নিশ্চিত নয়। ধারণা করা হচ্ছে, নক্ষত্রটি একটি হাইপারনোভাতে (এমন একটি শক ওয়েভ তৈরি হওয়া যার মধ্য দিয়ে নতুন নতুন তারার সৃষ্টি হয়) বিস্ফোরিত হবে। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন, ইউওয়াই স্কুটি নিজে নিজেই ভেঙে পড়বে এবং অপেক্ষাকৃত একটি উষ্ণ নক্ষত্র গড়ে উঠবে।
ডব্লিউওএইচ জি৬৪ নক্ষত্রটি সূর্যের চেয়ে আকারে ১ হাজার ৫৪০ গুণ বড়। ধারণা করা হয়, নক্ষত্রটি অত্যন্ত ধূলিময়। এটি ক্ষুদ্র বস্তুকণার পুরু স্তরে আবৃত থাকে। ক্ষুদ্র বস্তুকণার এই স্তরের ব্যাস প্রায় এক আলোকবর্ষ পর্যন্ত প্রসারিত।
সূর্যের তাপমাত্রার সঙ্গে তুলনা করলে ডব্লিউওএইচ জি৬৪ অপেক্ষাকৃত শীতল। এর তাপমাত্রা ৩ হাজার ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৫ হাজার ৬০০ ফারেনহাইট)। অন্যদিকে সূর্যের তাপমাত্রা ৫ হাজার ২২৬ দশমিক ৮৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৯ হাজার ৩৮০ দশমিক ৩৩ ফারেনহাইট)।
আরেক নক্ষত্রদানব ডব্লিউওএইচ ৫১৭০–এর অবস্থান ডোরাডো নক্ষত্র মণ্ডলে। লাল রঙের এই নক্ষত্রটি সূর্যের চেয়ে ১ হাজার ৪৬১ গুণ বড়।
আরএসজিসি১-এফ০১ নামের বিশালাকারের এই নক্ষত্রের অবস্থান মিল্কি ওয়ে বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথের একটি নক্ষত্র মণ্ডলে। এই নক্ষত্র মণ্ডলটির নাম স্কুটাম। নক্ষত্রটি আকারে সূর্যের চেয়ে ১ হাজার ৪৩৬ থেকে ১ হাজার ৫৩০ গুণ বড়। আরএসজিসি১-এফ০১ নক্ষত্রটিকে যদি আমাদের সৌরজগতের কেন্দ্রে স্থাপন করা হয়, তাহলে এই নক্ষত্রের পৃষ্ঠ ভাগ (ফটোস্ফিয়ার নামে পরিচিত) বৃহস্পতির কক্ষপথে পৌঁছে যাবে।
এইচডি ২৬৯৫৫১ নক্ষত্রটি আকারে সূর্যের চেয়ে ১ হাজার ৪৩৯ গুণ বড়। তালিকায় থাকা অন্য বড় নক্ষত্রগুলোর মতো এটিও অবিশ্বাস্য রকমের অস্থিতিশীল। এইচডি ২৬৯৫৫১ নক্ষত্রটির আয়ুষ্কাল প্রায় শেষের পথে। ধারণা করা হয়, কয়েক লাখ বছরের মধ্যে এটির আয়ু ফুরাবে। আর আয়ুষ্কাল শেষ হওয়ার পর নক্ষত্রটি একটি সুপারনোভার মধ্যে বিস্ফোরিত হবে বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। কয়েক লাক বছরের মধ্যে তেমনটা ঘটতে পারে।
এটি অক্সিজেনসমৃদ্ধ একটি দানব আকারের নক্ষত্র। সূর্যের চেয়ে ভিওয়াই ক্যানিস মেজোরিসের আকার ১ হাজার ৪২৯ গুণ বড়। নক্ষত্রটি এতটাই বড় যে আলোর গতিতে চললেও এর পৃষ্ঠের চারপাশে ভ্রমণ করতে আপনার ছয় ঘণ্টা সময় লেগে যাবে। অথচ একই গতিতে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে সময় লাগবে মাত্র ১৪ দশমিক ৫ সেকেন্ড।
ভিওয়াই ক্যানিস মেজোরিসের তাপমাত্রা ৩ হাজার ৭৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৬ হাজার ৭৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। এই নক্ষত্র অবিশ্বাস্য রকমের উজ্জ্বলও। এটি সূর্যের চেয়ে প্রায় তিন লাখ থেকে পাঁচ লাখ গুণ বেশি উজ্জ্বল।
এইচডি ১২৪৬৩ নামের নক্ষত্রটি সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য জানা যায়নি। তবে নিঃসন্দেহে এটি একটি বিশাল আকারের নক্ষত্র। এর আকার সূর্যের আকারের চেয়ে ১ হাজার ৪২০ গুণ বড়। এইচডি ১২৪৬৩-এর অবস্থান লার্জ ম্যাজেলানিক ক্লাউড নামক ছায়াপথের মধ্যে, যেটা মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা থেকে জন্ম নিয়েছে। পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১ লাখ ৬৩ হাজার আলোকবর্ষ।
সিএম ভেলোরাম নক্ষত্রটির অবস্থান ভেলা নক্ষত্র মণ্ডলে। লাল রঙা এই নক্ষত্র সূর্যের চেয়ে ১ হাজার ৪১৬ গুণ বড়। অবশ্য আকারে বড় হলেও নক্ষত্রটিকে টেলিস্কোপ ছাড়া খালি চোখে দেখা যায় না। পৃথিবী থেকে নক্ষত্রটির দূরত্ব বেশি হওয়াকে এর একটি কারণ বলে মনে করা হয়। পৃথিবী থেকে নক্ষত্রটির অবস্থান প্রায় ১৫ হাজার আলোকবর্ষ দূরে।
এএইচ স্করপি নক্ষত্রটির অবস্থান স্করপিয়াস নক্ষত্র মণ্ডলে। লাল রঙের বিশাল আকারের নক্ষত্রটি সূর্যের চেয়ে ১ হাজার ৪১১ গুণ বড়। তবে নক্ষত্রটি তুলনামূলকভাবে সূর্যের চেয়ে কম উষ্ণ। এর পৃষ্ঠ ভাগের তাপমাত্রা ৩ হাজার ১৭৬ দশমিক ৮৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৫ হাজার ৭৫০ দশমিক ৩৩ ফারেনহাইট) থেকে ৩ হাজার ৪০৮ দশমিক ৮৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের (৬ হাজার ১৬৭ দশমিক ৯৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট) মধ্যে। আর সূর্যের তাপমাত্রা ৫ হাজার ২২৬ দশমিক ৮৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৯ হাজার ৩৮০ দশমিক ৩৩ ফারেনহাইট)।
বিশাল আকারের আরেক নক্ষত্র এইচভি ৮৮৮। এর সৌর ব্যাসার্ধ সূর্যের তুলনায় ১ হাজার ৩৭৪ গুণ। বিজ্ঞানীদের ধারণা, নক্ষত্রটির আয়ুষ্কাল শেষ হওয়ার পথে। তবে কখন এ নক্ষত্রটির সুপারনোভা বিস্ফোরণ হবে, তা বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন। এটা এখনই হতে পারে আবার নক্ষত্রটি লাখ লাখ বছরও এটি টিকে যেতে পারে। আর সে পর্যন্ত অসাধারণ রকমের জ্বলজ্বল করবে এইচভি ৮৮৮। এটি আমাদের সূর্যের চেয়ে প্রায় তিন লাখ থেকে পাঁচ লাখ গুণেরও বেশি উজ্জ্বল। অন্যভাবে ব্যাখ্যা করলে বলা যায়, এটি এতটাই উজ্জ্বল যে এইচভি ৮৮৮ নক্ষত্রের সম্ভাব্য এক্সোপ্ল্যানেটে (সৌরজগতের বাইরের নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে আবর্তিত গ্রহ) কেউ থাকতে গেলে তাকে বেশ ভালো মানের সানগ্লাস পরতে হবে।