মতুয়া ভোটারদের নাম না ওঠায় পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে উত্তেজনা
পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার গাইঘাটা থানার ঠাকুরনগর মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রধান তীর্থ ও পুণ্যভূমি হিসেবে পরিচিত। এখানেই মতুয়াদের প্রধান গুরু হরিচাঁদ–গুরুচাঁদ ঠাকুরের মন্দির ও আশ্রমের অবস্থান। প্রতিদিন শতশত ভক্ত আশ্রম দর্শন ও আশীর্বাদ নিতে এখানে আসেন।
তবে এই পুণ্যভূমিতে মতুয়াদের ভিতরে বিভেদের রাজনীতি শুরু হয়েছে। সম্প্রদায়ের ভক্তরা বর্তমানে দুটি ভাগে বিভক্ত। এক পক্ষের নেতৃত্বে আছেন মতুয়া মহাসংঘের একাংশের নেতা ও কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর এবং অন্যপক্ষে রয়েছেন রাজ্যসভার সদস্য মমতাবালা ঠাকুর।
এ দুই নেতা দুই মেরুতে অবস্থান করছেন। রাজনৈতিক সমর্থনের দিক থেকেও তাঁদের মধ্যে বিভাজন রয়েছে—একাংশ বিজেপির সঙ্গে যুক্ত আর অন্যাংশ তৃণমূলের সমর্থক। এ দুই নেতার উভয়ে মতুয়া গুরুদেবের বংশধর। তাঁরা নিজ নিজ বাসস্থানেও পৃথকভাবে থাকেন। এই পরিস্থিতি সম্প্রদায়ের ভক্তদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করছে এবং ঠাকুরনগরের ঐতিহ্যবাহী পুণ্যভূমিতেও এর ছাপ ফেলছে।
ভারতের সমন্বিত সংশোধিত ভোটার তালিকা প্রকাশের পর থেকে মতুয়া সম্প্রদায়ের বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে নতুন দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। সংশোধিত এই তালিকায় বহু মতুয়াদের নাম না থাকায় সম্প্রদায়ের একাংশ ক্ষিপ্ত হয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘদিন ধরে মতুয়াদের নাগরিকত্ব প্রদানের আশ্বাস দিয়ে আসছেন। তবে ২০ ডিসেম্বর মতুয়া–অধ্যুষিত নদীয়ার তাহেরপুরে এক বিরাট জনসভায় যোগ দেওয়ার কথা থাকলেও কুয়াশার কারণে সভাস্থলে উপস্থিত হতে পারেননি মোদি। হেলিকপ্টার ফিরে আসে দমদম বিমানবন্দরে। পরে তিনি একটি অডিও বার্তায় ভাষণ দেন। কিন্তু এতে মতুয়াদের নাগরিকত্ব বা সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মতুয়া সম্প্রদায়ের একাংশের মধ্যে আসন্ন ভোট ও নাগরিকত্ব নিয়ে উদ্বেগ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
সংশোধিত ভোটার তালিকায় বহু মতুয়াদের নাম না ওঠায় সম্প্রদায়ের একাংশ ক্ষিপ্ত হয়েছেন এবং ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করেছেন। পরের দিন প্রধানমন্ত্রী মোদি এক বার্তায় জানান, তিনি মতুয়াদের সঙ্গে আছেন। কুয়াশার কারণে সভাস্থলে উপস্থিত হতে না পারলেও তিনি আশ্বাস দেন যে মতুয়াদের উন্নয়নে তাঁর প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
তবু একাংশ মতুয়াদের মধ্যে সন্তুষ্টি তৈরি হয়নি। এরপর বিজেপি সংসদ সদস্য, মতুয়া নেতা ও কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর এক বিতর্কিত মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, এসআইআর প্রক্রিয়ায় যদি ৫০ লাখ রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর নাম বাদ যায়, তাহলে ১ লাখ মতুয়াদের নাম বাদ গেলেও তা একটু সহ্য করতে হবে।
মন্তব্যটি প্রকাশের পর থেকে একাংশ মতুয়া প্রতিবাদে জড়ো হন। বুধবার তাঁরা ঠাকুরনগরের মতুয়া আশ্রমে একত্র হন, যেখানে প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরের বাসভবন রয়েছে। প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শান্তনু ঠাকুরের সঙ্গে থাকা বিজেপি সমর্থকেরা এবং প্রতিবাদকারীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন।
এ ঘটনায় ৭ জন আহত হন। তাঁদের চাঁদপাড়া গ্রামীণ হাসপাতাল ও বনগাঁ মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। খবর পেয়ে ঠাকুরনগরে পুলিশ উপস্থিত হয়। এসডিওপিএ থেকে থানার ওসি পর্যন্ত কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছান।
আগামী বছরের এপ্রিল মাসে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে ২৯৪টি আসনে ভোট হবে। রাজ্যের ভোট বাজারে মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোটারদের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। উত্তর চব্বিশ পরগনা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা ও নদীয়া জেলায় প্রচুর মতুয়ার বসতি, যাঁরা ভোটের মাধ্যমে সরকার গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।
তবে সংশোধিত ভোটার তালিকায় মতুয়াদের নাম না ওঠায় সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজনৈতিক উত্তেজনা তীব্র আকার নিয়েছে। মতুয়ারা দাবি জানিয়েছেন, যেকোনো মূল্যে তাঁদের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
এ বিষয়ে এলাকার বিজেপি নেতারা জানিয়েছেন, মতুয়া ভোটারদের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।