সবচেয়ে বেশি হীরা উত্তোলন করা হয় কোন দেশগুলোয়

বিশ্বের অত্যন্ত দামি ও কাঙ্ক্ষিত রত্নের নাম হীরা। গয়না থেকে শুরু করে রাজমুকুট—সবখানেই হীরার দ্যুতি যেন অমলিন। বিরল রত্ন হলেও শুধু ২০২০ সালেই বিশ্বের বিভিন্ন খনি থেকে প্রায় ১৪ কোটি ২০ লাখ ক্যারেট হীরা উত্তোলন করা হয়েছে। ১৮৭০ সালের পর থেকে আফ্রিকা, বিশেষ করে বতসোয়ানা ও দক্ষিণ আফ্রিকার খনিগুলো থেকে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের হীরা উত্তোলন করা হয়েছে।

হীরার প্রায় ৮০ শতাংশই শিল্পকারখানায় ব্যবহার করা হয়। বিশ্বের কোন দেশগুলো থেকে সবচেয়ে বেশি হীরা উত্তোলন করা হয়, তার একটি তালিকা করেছে ফ্রান্সভিত্তিক বিজ্ঞানবিষয়ক ওয়েবসাইট ফিউচারা সায়েন্সেস (ফরাসি উচ্চারণে ‘ফ্যুতুরা সিয়ঁস’)।

২০২০ সালের হিসাব অনুসারে তালিকাটি করা হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী, হীরা উত্তোলনকারী শীর্ষ ১০ দেশ সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক:

রাশিয়া

রাশিয়ার আলরোসা কোম্পানির একটি হীরা পরীক্ষা করছেন এক কর্মী
ফাইল ছবি: রয়টার্স

১০ বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় হীরা উত্তোলনকারী দেশ হিসেবে অবস্থান ধরে রেখেছে রাশিয়া। আর্কটিক সার্কেলের কাছে সাখা অঞ্চলের উদাচনায়া ও মির খনিই এর প্রধান উৎস। মির খনিতে ১৯৮০ সালে পাওয়া গিয়েছিল রাশিয়ার সবচেয়ে বড় হীরা। ৩৪২ ক্যারেটের এ হীরকখণ্ড ‘টোয়েন্টি সিক্সথ কংগ্রেস অব দ্য কমিউনিস্ট পার্টি অব দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন’ নামে পরিচিতি পায়।

বর্তমানে রুশ খনি কোম্পানি আলরোসা একাই বিশ্বের মোট হীরার প্রায় ২৭ শতাংশ বাজারে সরবরাহ করে। আলরোসার ৩৩ শতাংশের মালিকানা রুশ সরকারের। আনুমানিক হিসাবে, রাশিয়ায় ৬৫ কোটি ক্যারেট হীরার মজুত আছে। ২০২০ সালে দেশটিতে ২ কোটি ৩০ লাখ ক্যারেট হীরা উত্তোলন করা হয়েছে।

বতসোয়ানা

বতসোয়ানায় প্রদর্শনীর জন্য হীরা সাজিয়ে রাখা হয়েছে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

বতসোয়ানা হীরার উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে। দেশটির জওনেং খনি থেকে বছরে ১ কোটি ২০ লাখ থেকে ১ কোটি ৫০ লাখ ক্যারেট হীরা উত্তোলন করা হয়। এটি বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান খনি হিসেবে পরিচিত।

বতসোয়ানা সরকার এবং ডি বিয়ার্স (বিশ্বের অন্যতম প্রধান হীরাখনি পরিচালনাকারী ও বাণিজ্য সংস্থা) যৌথভাবে খনিটি পরিচালনা করে। বতসোয়ানায় আনুমানিক ৩১ কোটি ক্যারেট হীরার মজুত আছে। ২০২০ সালে দেশটিতে ১ কোটি ৬০ লাখ ক্যারেট হীরা উত্তোলন করা হয়েছে।

কানাডা

কানাডার খনি থেকে উত্তোলিত এক অপরিশোধিত হীরকখণ্ড
ফাইল ছবি: রয়টার্স

কানাডায় হীরা আবিষ্কার হওয়াটাই ছিল এক চমকপ্রদ ঘটনা। ১৯৯৮ সালে দেশটিতে বাণিজ্যিকভাবে হীরা উত্তোলনের কাজ শুরু হয়। বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ হীরা উত্তোলনকারী দেশগুলোর একটি কানাডা।  

তবে কানাডার উত্তরাঞ্চলের কিছু খনি বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ, দুর্গম ও বরফাচ্ছন্ন অঞ্চলে খননকাজ চালানো খুবই কঠিন। কানাডায় আনুমানিক ৩১ কোটি ক্যারেট হীরার মজুত আছে। ২০২০ সালে দেশটিতে ১ কোটি ৩০ লাখ ক্যারেট হীরা উত্তোলন করা হয়েছে।

অ্যাঙ্গোলা

অ্যাঙ্গোলার একটি খনি থেকে উত্তোলিত বিরল গোলাপি হীরা
ফাইল ছবি: এএফপি

অ্যাঙ্গোলা ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে হীরা উত্তোলন করছে। হীরা উৎপাদনকারী শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় অ্যাঙ্গোলার অবস্থান চতুর্থ। দেশটির লুলো খনি থেকে ১০০ ক্যারেটের বেশি ওজনের ১৬টি হীরা পাওয়া গেছে।

রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অ্যাঙ্গোলায় মজুত থাকা হীরার পরিমাণ কত, তার পুরোপুরি হিসাব করা যায়নি। ২০২০ সালে দেশটি ৮৫ লাখ ক্যারেট হীরা উত্তোলন করেছে।

দক্ষিণ আফ্রিকা

দক্ষিণ আফ্রিকার খনিতে পাওয়া বিরল নীল হীরা
ফাইল ছবি: রয়টার্স

হীরা উত্তোলনকারী শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় দক্ষিণ আফ্রিকার অবস্থান পঞ্চম। এখানকার খনি থেকে অত্যন্ত মূল্যবান নীল হীরাসহ কিছু বিরল ধরনের হীরা পাওয়া যায়।

দক্ষিণ আফ্রিকার কালিনান খনি বিশ্বে অপরিশোধিত হীরার সবচেয়ে বড় মজুতকেন্দ্র। তবে এখন ফিন্সচ ও ভেনেশিয়া খনির তুলনায় এ খনির গুরুত্ব কমে গেছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় আনুমানিক ৫ কোটি ৪০ লাখ ক্যারেট হীরার মজুত আছে। ২০২০ সালে দেশটিতে ৭৭ লাখ ক্যারেট হীরা উত্তোলন করা হয়েছে।

কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র

শীর্ষ হীরা উত্তোলনকারী দেশের তালিকায় কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ষষ্ঠ অবস্থানে। ধারণা করা হয়, বৈধ শ্রমিকের বাইরেও কঙ্গোতে প্রায় ৭ লাখ খনিশ্রমিক কাজ করেন। কঙ্গোতে উৎপাদন ভালো হলেও দেশটির হীরার মান তুলনামূলক কম। এখানকার উত্তোলিত হীরার মাত্র ২০ শতাংশ গয়না বা উচ্চমূল্যের রত্ন হিসেবে ব্যবহারযোগ্য।

আবার কঙ্গোয় অনেক হীরাখনি থাকলেও সেগুলো খনন করা কঠিন। হীরা পাওয়ার জন্য প্রায়ই ৩০ মিটার বা এর বেশি গভীরে খুঁড়তে হয়। দেশটিতে আনুমানিক ১৫ কোটি ক্যারেট হীরার মজুত আছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে দেশটিতে ৩৭ লাখ ক্যারেট হীরা উত্তোলন করা হয়েছে।

নামিবিয়া

নামিবিয়া বিশ্বের সপ্তম বৃহৎ হীরা উত্তোলনকারী দেশ। নামিবিয়ায় সর্বপ্রথম হীরা উত্তোলন শুরু হয় ১৯০৮ সালে। অধিকাংশ হীরা উপকূলের কাছে পাওয়া যায়। এ অঞ্চলে হীরার কোনো স্থায়ী মজুত নেই।

ভূতাত্ত্বিকদের ধারণা, নামিবিয়ার হীরাগুলো প্রতিবেশী দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার কিম্বারলাইট মজুত থেকে নদীর পানির সঙ্গে মিশে চলে আসে। এখন এসব অস্থায়ী হীরার মজুত শেষ হয়ে আসায় সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি নামদেব গভীর পানির নিচে অনুসন্ধান চালাচ্ছে। ২০২০ সালে নামিবিয়ায় ১৯ লাখ ক্যারেট হীরা উত্তোলন হয়েছে।

লেসোথো

হলুদ হীরা
ফাইল ছবি: রয়টার্স

শীর্ষ হীরা উত্তোলনকারী দেশের তালিকায় লেসোথোর অবস্থান অষ্টম। দেশটির দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত লেটসেং খনি থেকে বিশ্বের কিছু সেরা মানের হীরা পাওয়া যায়। ২০০৬ সাল থেকে এখানে এমন ১০টির বেশি হীরকখণ্ড পাওয়া গেছে, যার একেকটির ওজন ৩০০ ক্যারেটের বেশি।

এসবের মধ্যে ২০২০ সালে পাওয়া ৪৪২ ক্যারেটের হলুদ হীরা ও ২০১৮ সালে আবিষ্কৃত ৯১০ ক্যারেটের বিখ্যাত ‘লেসোথো লিজেন্ড’ উল্লেখযোগ্য। লেসোথোতে ২০২০ সালে ১১ লাখ ক্যারেট হীরা উত্তোলন হয়েছে।

অস্ট্রেলিয়া

অস্ট্রেলিয়া ১৯৮১ সাল থেকে হীরা উত্তোলন শুরু করেছে। খুব দ্রুতই অস্ট্রেলিয়া রত্নমানের হীরার শীর্ষ উৎপাদনকারী দেশ হয়ে ওঠে। তবে দেশটির হীরার ভান্ডার দ্রুত ফুরিয়ে যায় এবং উৎপাদন ক্রমে কমতে থাকে।

অস্ট্রেলিয়ার প্রধান খনি আর্গাইল ২০২০ সালে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এ খনি বিশেষভাবে গোলাপি হীরার জন্য বিখ্যাত ছিল। এ ধরনের গোলাপি হীরা ল্যাম্প্রোইট চিমনি নামের শিলা থেকে উত্তোলন করা হতো, যা কিম্বারলাইটের তুলনায় অনেক বিরল। অস্ট্রেলিয়ায় হীরার মজুতের পরিমাণ ৩ কোটি ৯০ লাখ। ২০২০ সালে ৩ লাখ ৪০ হাজার ক্যারেট হীরা উত্তোলন করা হয়েছে।

১০

তানজানিয়া

বিশ্বে হীরা উত্তোলনের দিক থেকে তানজানিয়ার অবস্থান দশম। আর আফ্রিকা মহাদেশে দেশটির অবস্থান অষ্টম। ২০২০ সালে দেশটি ২ লাখ ৬০ হাজার ক্যারেট হীরা উত্তোলন করেছে। এর বেশির ভাগই দেশের উত্তরে অবস্থিত উইলিয়ামসন খনি থেকে উত্তোলন করা হয়।

এই খনির অবস্থান লেক ভিক্টোরিয়া থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে। ১৯৪০ সালে আবিষ্কৃত এ খনি এখনো চালু আছে। এটি বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো সক্রিয় খনিগুলোর একটি।