জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর স্থলভাগের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বা ৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন হেক্টর এলাকায় বনভূমি রয়েছে। শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য গাছপালার বিকল্প নেই। এ ছাড়া বাড়িঘর, আসবাব, এমনকি ওষুধের জন্যও আমরা বনের ওপর নির্ভরশীল। পৃথিবীর মোট বনভূমির বেশির ভাগ নির্দিষ্ট কিছু দেশে অবস্থিত। ওয়ার্ল্ডোমিটারসের তথ্য অনুযায়ী শীর্ষ ১০ বনভূমির দেশ পাঠকদের জন্য এখানে তুলে ধরা হলো।
রাশিয়ায় পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বনভূমি রয়েছে। দেশটিতে ৮১ কোটি ৪৮ লাখ ৪৮ হাজার ৪৬০ হেক্টর বনভূমি রয়েছে। বিশ্বের মোট বনভূমির ২০ দশমিক ৪১ শতাংশই রাশিয়ায়।
পৃথিবীর মোট আবাসযোগ্য জমির আট ভাগের এক ভাগ পড়েছে রাশিয়ায়। আয়তনের বিশালত্বের কারণে দেশটি নয়টি সময় অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। দেশটির বনভূমির বড় অংশ রয়েছে ফার ইস্টার্ন ফেডারেল অঞ্চলে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে সাইবেরিয়ান ফেডারেল অঞ্চল। এসব এলাকার বেশির ভাগ গাছই লার্চ, পাইন ও স্প্রুস জাতের।
রাশিয়ার পরই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বনভূমির দেশ ব্রাজিল। লাতিন আমেরিকার এ দেশে ৪৯ কোটি ১৫ লাখ ৫৭ হাজার হেক্টর বনভূমি আছে। ২০২২ সালে দক্ষিণ আমেরিকার এ দেশে মোট বনভূমির পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৯ কোটি ৪০ লাখ হেক্টর। চিরহরিৎ আমাজন বনের প্রায় ৬২ শতাংশ ব্রাজিলে অবস্থিত। আমাজনকে অনেকে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ বলে থাকেন।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাজনে বন উজাড় একটি মারত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবৈধভাবে গাছ কাটা ও অগ্নিকাণ্ডের কারণে বন ধ্বংস বেড়েছে। ২০২৩ সালেই ব্রাজিলে আমাজনের প্রায় আট হাজার বর্গকিলোমিটার বনভূমি ধ্বংস হয়েছে।
বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বনভূমির দেশ কানাডা। দেশটির মোট বনভূমির পরিমাণ ৩৪ কোটি ৬৯ লাখ ৭৫ হাজার ৮০০ হেক্টর। কানাডার বনশিল্প দেশটির মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
২০২১ সালে কানাডায় বনশিল্পের নমিনাল জিডিপি ছিল ৩৪০ কোটি কানাডিয়ান ডলার। এর মধ্যে শুধু কাঠজাত পণ্য উৎপাদন খাত থেকেই এসেছে প্রায় ১৯০ কোটি ৮০ লাখ ডলার।
কানাডার বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় সবচেয়ে বড় বন ও গাছ কাটা শিল্পকেন্দ্র আছে। এরপরে কুইবেক ও অন্টারিওতে।
বনভূমির দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান চতুর্থ। দেশটিতে ৩১ কোটি ৬ লাখ ৪৫ হাজার হেক্টর বনভূমি রয়েছে। এ বিশাল বনভূমি যুক্তরাষ্ট্রের জলবায়ু, জীববৈচিত্র্য ও বনসম্পদভিত্তিক অর্থনীতির ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে।
যুক্তরাষ্ট্রের মেইন অঙ্গরাজ্য সবচেয়ে ঘন বনভূমি আচ্ছাদিত রাজ্য। এ অঙ্গরাজ্যের মোট ১ কোটি ৯০ লাখ একর জমির মধ্যে ১ কোটি ৭০ লাখ একরজুড়েই বনভূমি, যা রাজ্যের মোট বনভূমির প্রায় ৮৯ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রের মোট বনভূমির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই টিম্বারল্যান্ড। এ বনভূমি থেকে শিল্পে ব্যবহারের উপযোগী কাঠ উৎপাদিত হয়। তবে এমন বনভূমির অধিকাংশই ব্যক্তিমালিকানাধীন।
যুক্তরাষ্ট্রের পরের অবস্থানে রয়েছে চীন। এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বনভূমি আছে চীনে। দেশটিতে বনভূমির পরিমাণ ২১ কোটি ১৪ লাখ ৫ হাজার ৭০০ হেক্টর, যা বিশ্বের মোট বনভূমির ৫ দশমিক ৩০ শতাংশ।
২০২৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চীনের বনভূমির বড় অংশ ইনার মঙ্গোলিয়ায়। অপর দিকে গুয়াংজি প্রদেশে সবচেয়ে বেশি কাঠ উৎপন্ন হয়।
২০২৪ সালে চীন প্রায় ৪৫ লাখ হেক্টর জমিতে বৃক্ষ রোপণ করেছে। ফলে দেশটিতে মোট বনভূমির আচ্ছাদন ২৫ শতাংশের বেশি হয়েছে। দেশটি এখন পর্যন্ত মোট ৭৭ কোটি ৩০ লাখ হেক্টর এলাকায় বনায়ন করেছে, যা বৈশ্বিকভাবে সবচেয়ে বেশি সবুজায়ন বৃদ্ধির রেকর্ড।
আফ্রিকার দেশ কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র বা ডিআরসির বনভূমির পরিমাণ কোটি ১৯ লাখ ৫৫ হাজার ২০০ হেক্টর। যার প্রায় সবটাই কঙ্গো নদীর অববাহিকায় অবস্থিত—বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম চিরহরিৎ বনভূমি অঞ্চল।
কঙ্গো অববাহিকা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অক্ষত ক্রান্তীয় বনভূমির আবাসস্থল। এ বনভূমি শুধু জীববৈচিত্র্যের জন্যই নয়; বরং বৈশ্বিক কার্বন শোষণের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে অঞ্চলটি বর্তমানে হুমকির মুখে রয়েছে। সড়ক নির্মাণ, মানুষের আনাগোনা ও জলবায়ু পরিবর্তন এর জন্য দায়ী।
বিশ্বে বনভূমির দিক থেকে সপ্তম অবস্থানে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া। বিশ্বের মোট বনভূমির প্রায় ৩ শতাংশ অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থিত।
অস্ট্রেলিয়ার বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে প্রায় ১৩ কোটি ৩৬ লাখ হেক্টর বনভূমি রয়েছে, যা দেশের মোট ভূমির ১৭ শতাংশ। ২০২১ সালের হিসাবে বনভূমির মধ্যে ১৩ কোটি ১৫ লাখ হেক্টর প্রাকৃতিক বন। ১০ লাখ ৮২ হাজার হেক্টর বাণিজ্যিক বনায়ন। ২ লাখ ৪ হাজার হেক্টর অন্যান্য বনভূমি।
অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড রাজ্যে সবচেয়ে বড় বনভূমি রয়েছে। যার পরিমাণ ৫ কোটি ১৮ লাখ হেক্টর। অস্ট্রেলিয়ার মোট বনভূমির ৩৯ শতাংশই এ রাজ্যে। এরপর নর্দার্ন টেরিটরি। এর আয়তন ২ কোটি ৩৩ লাখ হেক্টর।
বিশ্বে বনভূমির দিক থেকে এশিয়ার দেশ ইন্দোনেশিয়ার অবস্থান অষ্টম। দেশটির বনভূমির আয়তন ৮ কোটি ৯৬ লাখ ৪১ হাজার ২০০ হেক্টর। মোট ভূখণ্ডের ৬৩ শতাংশ এলাকাকে রাষ্ট্রীয় বনভূমি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
১৯৯৯ সালের বন আইন অনুযায়ী, দেশটির বনভূমিকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সেগুলো হলো উৎপাদন বন, সুরক্ষা বন ও সংরক্ষিত বন। মূলত আইনি উদ্দেশ্যে বনভূমির ব্যবহার করতে এই শ্রণিবিভাগ করা হয়েছে।
বনভূমির দিক থেকে লাতিন আমেরিকার দেশ পেরু নবম অবস্থানে আছে। দেশটিতে মোট বনভূমির পরিমাণ ৭ কোটি ৩৬ লাখ ৩৭ হাজার ৮০০ হেক্টর।
পেরু বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ক্রান্তীয় বনভূমির দেশ। বিশ্বের সবচেয়ে জীববৈচিত্র্যপূর্ণ দেশগুলোর একটি পেরুর বনভূমি। বিশ্বের প্রায় এক-দশমাংশ উদ্ভিদ প্রজাতি পেরুতে পাওয়া যায়। পেরুভিয়ান আমাজন আকারে ফ্রান্সের আয়তনের চেয়েও বড়।
আমাজনের ক্রান্তীয় বনভূমির সবচেয়ে বড় অংশ ব্রাজিলে, এরপর পেরুতে। তবে সম্প্রতি দেশটিতে ব্যাপক হারে বন উজাড় হচ্ছে। ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় সবচেয়ে বেশি বন উজাড় হয়েছে। ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দেশটিতে যে পরিমাণ বন উজাড় হয়েছে, তার আয়তন নেদারল্যান্ডসের প্রায় অর্ধেক।
বিশ্বের শীর্ষ ১০ বনভূমির তালিকায় দশম অবস্থানে রয়েছে এশিয়ার দেশ ভারত। দেশটিতে মোট বনভূমির পরিমাণ ৭ কোটি ১০ লাখ ৩৮ হাজার ৮০০ হেক্টর।
ভারতের ভৌগোলিক আয়তনের ২৫ দশমিক ১৭ শতাংশ বন ও গাছপালায় আচ্ছাদিত। জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগের ফলে এ সাফল্য পেয়েছে দেশটি। গত মে মাসে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ ফরেস্ট ফোরামে উপস্থাপিত দেশটির বন বিভাগের প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
তথ্যসূত্র: এফএও, ওয়ার্ল্ডোমিটারস, স্টাটিস্টা, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম